Enewstime Article Images
Feature

Maha Parinirvan (মহাপরিনির্বাণ)

নীল আকাশে ভেসে চলা মেঘ আর কাশফুলের সাদা রঙে যখন সোনালী রঙ লাগে, তখনই রমাপদ ঢাকের ধুলো ঝেড়ে ঝুরে রোদে দেয়। পবন এসে হাঁক মারে রমাপদ দরজায়,'' বায়না পেলে ? পুজো তো এসে গেল।'' রমাপদ মনেমনে নতুন বোল বাঁধতে বাঁধতে মাথা নাড়ে,''ইবারেও নতুন পল্লী''। 

- টাকা বাড়ায়নি ? 

- হুম । দু'হাজার বেশী দিবে ইবার। বেটাকে নিয়া যাব। কাঁসর বাজাবে । উহাকেও জামা দিবে।

-আমার ঐ একই কিলাবে। একহাজার বেশ দিবে,  জামাও দিবে।

রমাপদর সবেধন নীলমণি ছেলে রতন। শহরের পুজো দেখতে যাবে বলে বায়না ধরেছে এবার। সেজন্য রতনকে নিয়ে যাওয়া । রতন এইটে পড়ে। মাস্টারমশাই বলেন , ''উহার মাথা খুব ভালো । বেটারর পড়াটা কখনো থামাস নি রমা'' ।

রমাপদ ও চায় ছেলে বিএ পাশ দিক। মস্ত চাকরি করুক।

 

Durga-Puja-Covid-19

 

ঝাড়খন্ডের গা ঘেষে বীরভূমের প্রত্যন্ত গ্রাম সুদ্রাক্ষীপুর । সেখানে বেশ কয়েকঘর ঢাকির বাস।রমাপদর মুদির দোকান । সারাবছর মুনিষ খেটে,জমি চষে বাপ অন্য কোনো কাজ করে চললেও ভাদুর বিসর্জন হয়ে গেলে রমাপদ , পবনদের মনটা আনচান করে ওঠে। ওরা যে বংশপরম্পরায় ঢাকি! শ্যাম বাদ্যকর, রূপচাঁদ বাদ্যকরের বংশধর । আশ্বিনের সোনালী আকাশে সাদা মেঘের সঙ্গে ঢাকের বোল ভাসে। হালকা ঠান্ডা আমেজে যখন কাশফুল তিরতির করে কাঁপে তখন সেই বোল  ঢাকের কাঠিতে ধরা দেয়। রক্তে নেশা লাগে। ঢাকের ছইএ রোদের তাপ দিয়ে প্রস্তুতি নেয় বায়না ধরার। তারপর পঞ্চমীর আগেই উঠে বসে  বাসে। শহরের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়ে ওরা। 

রমাপদ বাদ্যকর যাবে দুর্গাপুরে । প্রতিবারই যায়। আবাসনের পুজো। দুপুরবেলা বাস থেকে ছেলে রতনকে নিয়ে যখন নামল তখন খিদে তে পেট চুঁই চুঁই করছে। পুজোকর্তাদের ব্যবস্থাপনায় আবাসনের একটি ঘরেই রমাপদ আর রতনের থাকার জায়গা হল। পুজোর চারদিন রতন চেয়ে চেয়ে দেখলো শহরের ছেলেমেয়ে, নারী পুরুষকে। সে বাপের ঢাকের সঙ্গে কাঁসর বাজায় আর ভাবে, ''বাপরে ! ইহাদের দেখলে  সিনেমার হিরো হিরোইন মন্নে হয়।'' তারবয়সী ছেলেমেয়েদের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে রতন। বাপকে জিজ্ঞেস করে,''উহারা খুব বড়লোক ? কি সোন্দর জামা !'' বাপ বলে,''রতন, ভালো করি লিখাপড়্যা কর। তুই ও পরবি।''  

খুব খুশি হয়ে ফিরেছিল রতন। মন লাগিয়েছিল পড়াতে।  তাকে ভালো রেজাল্ট করতেই হবে। এইট থেকে নাইনে উঠবার সময়ে থার্ড হয়েছিল। রমাপদর বুক গর্বে ফুলে উঠেছিল। বুঝেছিল ছেলের পড়াশোনা ঠিকমতো চালাতে হলে রোজগার আরও বাড়াতে হবে। মুদির দোকানের ওপর ভরসা করলে চলবে না। দুর্গাপুর,  বর্ধমান বা কলকাতা গিয়ে দেখবে নাকি একবার! রতনের মাকে কথাটা বলেই ফেলল রমাপদ ।

স্বামীর যুক্তি শুনে সায় দিয়েছিল কমলা। সংসার আর ছেলের পড়ালেখার খরচ সামলাতে গেলে বাড়তি রোজগারের দরকার আছে বৈকি । 

মুদির দোকানের দায়িত্ব কমলার ওপর দিয়ে কলকাতাবাসী হল রমাপদ। উচ্চমাধ্যমিক পাশ রমাপদ একটা মিষ্টির দোকানে কাজে লাগলো। নামী দোকান। টাকা পয়সা যা দেয় পুষিয়ে যায়। মাসে একদিন বাড়ি আসে। ছেলে ক্লাস নাইন। সন্ধ্যেবেলা প্রাইভেটে 'মাস্টার'র কাছে পড়তে যায়। সব মিলিয়ে বেশ চলছিল সংসার। পুজোর সময়ে ছুটি পাবে সে। কিন্তু নবমীর দিন  দোকানে যেতেই হবে। তাই ঢাকের বায়না  নিয়ে এবার কিছুটা দোলাচালে রমাপদ । শেষে কমলা আর রতনের কথায় গররাজি হয়। দুর্গাপুরের পুরোনো ক্লাবের বায়নাটা নেয় রমাপদ ।  সপ্তমী, অষ্টমী কাটিয়ে নবমীর দিন সকালে কলকাতা চলে যায় সেখান থেকে । পুজো শেষ করার দায়িত্ব পড়ে রতনের ওপর। 

নবমীর সন্ধ্যা ।   মনপ্রাণ ঢেলে ঢাকা বাজালো রতন। সন্ধ্যারতি জমে উঠল । কর্মকর্তারা খুশি হয়ে পিঠ চাপড়ে দিল রতনের। বলল,''বাহ্ ,বাপ কা বেটা।''

সামনে বাৎসরিক পরীক্ষা । মন দিয়ে পড়াশোনা করে রতন। এবার ক্লাস টেন হবে। কিন্তু পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে ঢাকা বাজানোর নেশাটা রতনকে পেয়ে বসেছে। রমাপদ বকাবকি করে। বলে ,'' ধরবি না ঢাক।'' কিন্তু মন মানে না রতনের। পরীক্ষাতে সে এবারও  ভালো ফল করেছে । রমাপদ আর কমলা ছেলেকে নিয়ে বড়ো গর্ব। আশা ,মাধ্যমিকে নিশ্চয়ই ভালো করবে। রতন ও জোরদার পড়াশোনা শুরু করেছে। মাঝে মাঝে যে ঢাক বাজায় না তা নয়, তবে সময়টা কম পায়। 

 

' শুনলি, ইবচ্ছরের উচ্চ মাধ্যমিকটা আর শেষ হল না কো'।   নবীন জানায় রতনকে। ওরা একসাথে একস্কুলে পড়ে। 

রতন অবাক হয়ে বলে,''কেনো বটে?'' 

নবীন নতুন একটা রোগের গল্প শোনায়।।সারা পৃথিবী জুড়ে মহামারী । লক্ষ লক্ষ লোক আক্রান্ত। খোদ ইউরোপ আমেরিকাতে। এ দেশেও এসে ঢুকেছে সেই মারণরোগ। 

মাস্টারের বাড়িতে খবরের কাগজ আসে। রতনকে টিউশন পড়তে গিয়ে দেখেছিল সেখানে করোনার কথা। সেদিন সন্ধ্যেবেলা পড়তে গিয়ে আরো ভালো করে খবরের কাগজটা পড়লো। কলকাতার শহরে ঢুকে পড়েছে এ রোগ। তার বাবা কেমন আছে?

  ''রাতে বাপকে একটা ফোন করব ''   আপনমনে বলে রতন। 

 

রাতে রমাপদর সাথে মোবাইল ফোনে কথা হয় মা আর ছেলের। শহরে লকডাউন শুরু হয়েছে ।ট্রেন বন্ধ । তাই ফেরার পথ নেই । দোকানেই কাটাবে ওরা সবাই মিলে। দুদিন পরে লকডাউন উঠে গেলে বাড়ি ফিরবে। আর দোকান খুলে গেলে তো কাজের মধ্যেই থাকবে। 

রমাপদ ফিরে এসেছিল প্রায় মাস দেড়েক পরে। পায়ে হেঁটে । ট্রেন বাস বন্ধ ।রোজগার বন্ধ । প্রথমদিকে মালিক খাবারদাবার দিচ্ছিল। কিন্তু এভাবে কতদিন চলবে? অনিশ্চয়তা ক্রমাগত দানা বেঁধেছে । ব্যস্ত শহরের ছবি চোখের সামনে হঠাৎই বদলে গেছে। দোকান বন্ধ । এক আধদিন খোলার হুকুম হলেও ব্যবসা হচ্ছে কোথায়? খদ্দের  নেই। মাঝেমাঝেই অ্যামবুলেন্সের শব্দ,  পুলিশের ভ্যান ,দু একটা টুংটাং সাইকেল বা মোটরবাইকের সাঁ করে চলে যাওয়া। মৃত্যু মিছিলে সামিল কলকাতা। 

গ্রামে ফিরে হতাশা গ্রাস করছিল ধীরে ধীরে । ছেলের স্কুল বন্ধ । টিউশনই ভরসা।পয়সার অভাবে সেটাও বন্ধ হতে চলেছে।  এমন সময়ে ফোনটা আসে কলকাতা থেকে, ''দোকান খুলছে। 

কাজে আসতে পারলে চলে এসো,তবে কবে বাড়ি ফিরতে পারবে বলতে পারছি না।''

''পুজোর আগে নিশ্চয়ই সব ঠিক হয়ে যাবে। তখন আসব। আর এবার আর বায়না নেব না। পুজোর কটাদিন বাড়িতেই থাকব।'' ' দুগ্গা, দুগ্গা' বলে আরও অনেকের সাথে একটা গাড়ি ভাড়া করে রওনা হল রমাপদ । 

 

বৃত্তটা ক্রমাগত ছোট হয়ে আসছিল, 

মুক্তি নেই ভেবে যখন প্রাণ ছটফট করছিলো,

তখন জানা গেলো আছে মুক্তি

বৃত্তের কেন্দ্রই,

আছে চির শান্তি।

 

আজ সপ্তমী। দেবীর বোধন হচ্ছে । পিঠে ঢাক ঝুলিয়ে বাজিয়ে যাচ্ছে রতন। দুর্গাপুরে পুরোনো ক্লাবে ও এসেছে এবার একা।  ওকে গাড়িতে করেই নিয়ে এসেছে ক্লাবের কর্মকর্তারা। রমাপদর খবরটা ওদের কাছেও পৌঁছেছিল যে। কলকাতা যাবার একমাস পরেই রমাপদ অসুস্থ হয়ে পড়ে । কোভিড টেস্টের রেজাল্ট পজিটিভ । সরকারী হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় তাকে। এটুকু খবর পেয়েছিল কমলা আর রতন। বাকি খবরটা নিয়ে এসেছিল মালিকের এক লোক। গাড়িতে করে দিয়ে গেছিল রমাপদর ফোন ,ঘড়ি আর অন্যান্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র , তিনমাসের মাইনে সহ বিশহাজার টাকা। বলছিল রতনকে পাঠাবে কিনা ভেবে বলতে। কমলা রাজি হয়নি। 

এসব ভাবতে ভাবতে রতনের চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে । আঙুলগুলো অভ্যাসবশতঃ বোল তুলছে।  সামনে প্রতিমার পাশে রতন স্পষ্ট দেখছে রমাপদকে। উস্কোখুস্কো চুল, গাল বেয়ে নামা চোখের জলের শুকনো দাগ। একমুখ না কামানো দাড়ি নিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে হাতজোড় করে ,''মা গো , বেটারে   মানুষ করতে দিলি না কেনো? তোর পূজায় তো  আমি কখনো অনিয়ম করিনি?'' দেবীর মুখ ধুনোর ধোঁয়াতে ঢাকা। রতনের ঢাক বেজে চলেছে, বলছে,''বাপ তুই চিন্তা করিস না । আমি ঠিক বিএ পাশ দেবো।'' 

 

অসতো মা সদগময়, তমসো মা জ্যোতির্গময়ঃ

ওম মৃত্যর্মা অমৃতমঃ গময়ঃ শান্তি শান্তি ওম

শান্তি ওম, শান্তি ওম, হরি ওম তদসদ,

শান্তি ওম, শান্তি ওম, হরি ওম তদসদ ।।

You can share this post!