Enewstime Article Images
Talkies

The Spine : A Review, সাত্যকি রায় - তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা ?

মানস পাল

আগরতলাবাসী সাত্যকি রায় একজন আপাততুচ্ছ, মধ্যবিত্ত বাঙালি। স্ত্রী, কন্যা নিয়ে সে এক মধুর বৃত্তবন্দি আপাদমস্তক সংসারী । ভোরে উঠে সে ট্র্যাকস্যুট লাগিয়ে মর্নিং ওয়াক এ যায় , সম্ভবত সুগার বা প্রেসারের তাড়না থেকে কিছুটা মুক্তি পেতে , আর সকাল দশটা বাজলেই কোট প্যান্ট পড়ে গাড়ি চালিয়ে অফিসে গিয়ে ল্যাপটপ নিয়ে যেকোন আরেক বাঙালির মত ব্যস্ত হয়ে যায় রুটিন, ওই যাকে বলে দিনগত পাপক্ষয়ের কাজে -- সে প্রায় রাত হওয়া অব্দি। এ পর্যন্ত তো সব ঠিকই আছে। বোঝা গেলো সে আমার মতোই আরেক বাঙালি যে দৈনন্দিন জীবনের সমস্যার বোঝাপড়া করে, ছোটোখাটো আনন্দের বা অস্থিরতার মাঝে দিনাতিপাত করে চলেছে। এ আর নতুন কথা কি ? কিন্তু সমস্যা দাঁড়াল এসে যে জায়গায় সেটা হল - এই যে আমরা যাঁরা মধ্যবিত্ত এক অনিশ্চিত অর্থনীতির প্রোডাক্ট , তাঁরা নিজেরাই বুঝতে পারিনা আমার 'ঘরে বসত করে কয়জনা', নাহ , সেটা যে আমার মনও জানে না।

 

enewstime-Manas-Paul-The-Spineসাত্যকি রায় যাকে আগরতলা শহরে মোটামোটি সবাই চেনে জানে , যে জাঁ পল সাঁত্রে-কে প্রয়োজন মত উল্লেখ করতে পারে , যে একসময় ছাত্র জীবনে রাজনীতির সঙ্গেও কিছুটা জড়িত ছিল বলে জানতে পারলাম , সে কেন মাঝ রাত্তিরে বাড়ির উঠানে , বা ভোর বেলায় গান্ধীগ্রামের অক্সিজেন পার্কের জঙ্গলে , বা সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে অফিসের বাথরুমে হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে চলে ?

 

ব্যাপারটা কিছু বোঝা গেল ? একজন আপাতঃ সফল মধ্যবিত্ত সময় পেলেই, সুযোগ এলেই এবং কাছে ধারে কেউ না থাকলেই মাটিতে হামাগুড়ি দিয়ে পিছলে পিছলে কি যেন খুঁজতে থাকে, আর যদি কোন এক দৃঢ় সঠান গাছ দেখে তো তাকে জড়িয়ে ধরে সোজা হয়ে দাঁড়াতে চায়।

 

আচ্ছা, মনে আছে কাফকার সেই বিখ্যাত মেটামরফোসিস ? সেই যে গ্রেগর সামসা। এক উল্টাপাল্টা দুঃস্বপ্নের রাত কাটিয়ে গ্রেগর সামসা যখন ঘুম থেকে সকালে জেগে উঠল, তখন দেখে সে 'পোকা' হয়ে গেছে। বইটি শুরুই হয়েছিল এভাবে --When Gregor Samsa woke up one morning from unsettling dreams, he found himself changed"—okay, ordinary enough—"into a monstrous vermin." ....বিশ্বাস করতে পারেন একটা জলজ্যান্ত লোক, একটা তরতাজা মানুষ একটা 'পোকা ' হয়ে গেল ?? তা-ও মনস্ট্রাস ভারমিন। সে এক অদ্ভুত ব্যাপার। ইংরেজিতে যাকে বলতে পারি 'ভেরি আনসেটলিং'।

 

কিন্তু মিলটা দেখুন এই দুর্বোধ্য রূপান্তর--বেচারা নির্বিরোধ খেটে খাওয়া সেলসম্যান গ্রেগরের পোকা হয়ে যাওয়া অথবা সাত্যকি রায় নামক আমার এই শহর আগরতলার এক মধ্য বয়স্ক , আপাতঃ সফল মধ্যবিত্তের সরীসৃপের মত জমিতে পিছলে পিছলে কিছু খোঁজে যাওয়া-- কোথায় যেন একটা মিল রেখে যাচ্ছে । শুধু পার্থক্য গ্রেগর সামসার রূপান্তর চিরস্থায়ী , সাত্যকির ক্ষণ স্থায়ী। গ্রেগর পার্মানেন্টলি পোকা হয়ে গিয়েছিল , সাত্যকি সেটা হয়নি বটে , সে সময় সুযোগ পেলেই নরম মেরুদন্ডের সরীসৃপে পরিণত হয় , আবার স্বাভাবিকতায় ফিরে আসে-- অমিল এখানেই । কিন্তু দুজনেরই পারিবারিক জীবনে তাঁদের রূপান্তর মহা সমস্যা তৈরী করে। করবেই তো , কারো রোজগেরে ছেলে বা ভাই এক সকালে 'পোকা' হয়ে গেলো , তো' আরেক ভদ্রলোক রাত বিরেতে স্ত্রীর পাশে বিছানা ছেড়ে গিয়ে সরীসৃপ এর মত মাটিতে মিশে উঠানের আনাচে কানাচে কি খোঁজে বেড়াতে লাগলো। সমস্যা তো হবেই।

 

আসলে এই সমস্যাটা যত দুর্বোধ্য মনে হয় , তত দুর্বোধ্য কিন্তু নয়। নির্মম ? হ্যা সে ঠিক, এ এক নির্মম সত্য বটে । আসলে দিন শেষে যা থেকে যায় তাহল, সবকিছুর মুল- এই চিরস্থায়ী বা ক্ষণস্থায়ী দুটো রূপান্তরই অর্থবোধক। এক দুঃস্বপ্নতাড়িত অসহায়ত্ব। আর এই অসহায়ত্বই সম্ভবতঃ জীবনানন্দের শব্দে ভাষা পায় ---‘আরো এক বিপন্ন বিস্ময়/ আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে/খেলা করে’।

 

নবারুণ (ঘোষ) যখন আমাকে প্রথম বলল , মানস দা আমার 'দ্য স্পাইন' সিনেমাটি একটু দেখবে ? একটু অন্য ধরণের সিনেমা করতে চেয়েছি , তখন ভাবিনি বিষয়টা এতই 'অন্যধরনের' , ভেবেছিলাম অন্যধরণের হলেও আর কতটুকুই বা অন্যধরণের হবে। হয়ত একটু বেশি প্রতীক , একটু বেশি রূপক ব্যবহার করে একটু ভারিক্কি টাইপের কিছু একটা সিনেমা করেছে নবারুণ। কিন্তু, সিনেমাটি দেখার পর যে চিন্তা,যে শব্দটি মাথায় বারবার ঘোরপাক খাচ্ছিল সেটা হল 'কাফকায়েস্ক' .... পুরো ব্যাপারটিই বাস্তব আর পরাবাস্তবের মিশেলে এমন এক জাদুবাস্তব বা ম্যাজিক রিয়ালিটির আবহ তৈরী করেছে যে তার আবেশ থেকে বেরিয়ে এলেও সিনেমাটির যে ইঙ্গিত রেশ রেখে যায় তা থেকে বেরিয়ে আসা মুশকিল।

 

সিনেমাটি পুরোটাই প্রতীকী, আর রূপকধর্মী। আসলে চিত্রায়িত পুরো কাহিনীটাই এক অর্থে বিমূর্ত। ফলে অন্য যেকোন গল্পের মত একে যেমন দেখা উচিত হবে না তেমনি নিরেট বাস্তবের সাধারণ কোন কাহিনীর সঙ্গে এর তাল মিলিয়ে বিচার করাও সম্ভব নয়। ভিন্ন আঙ্গিকে তৈরী ইঙ্গিতধর্মী এই সিনেমায় একটি গাছ যদি সঠান মেরুদণ্ডের রূপক হয় , আর এক মাঝবয়েসী "একদা-প্রতিবাদী" বাঙালি যদি তার হারিয়ে ফেলা এই দৃঢ় মেরুদণ্ডের খোঁজে হেথায় হোথায় হামা দিয়ে , চুপি মেরে চলে, চলতেই থাকে --তাহলে অস্তিত্বের মূল্যহীনতা ওই সাত্যকি বা তার মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কোট করা সাঁত্রের সেই বিখ্যাত "বিয়িং এন্ড নাথিংনেস" -এর মতোই বড়ই কঠোর, কঠিন , বড়ই প্রবল হয়ে দর্শকের কাছে উপস্থাপিত হয়। ফলে আমার তাই হয়েছে। সিনেমাটি দেখে ঝিম মেরে বসে শুধু ভাবছিলাম --এরকমও সিনেমা তাহলে ত্রিপুরায় করা সম্ভব ? এভাবেও আমার , (অথবা আপনার ) হারিয়ে যাওয়া মেরুদণ্ডের অহর্নিশ খোঁজ, চিরায়িত অন্বেষণ উপস্থাপন সম্ভব? আসলে , আমি বা আপনি সবাই একেক জন সাত্যকি রায়। মোহময় এই বৃত্তবন্দী মধ্যবিত্তের মোহিনী জীবন যাপনের মাঝেও আমরা সবাই খোঁজ করে চলি --মেরুদণ্ডের।

 

enewstime-Tripura-the-spine-movie-Shankha-Ghoshশঙ্খ ঘোষের যে কবিতাটিকে নবারুণ সিনেমায় আনতে চেয়েছে সেই 'হামাগুড়ি' কবিতায় কবি বলছেন--'খুঁজছি তো ঠিকই , খুঁজতে তো হবেই , পেলেই বেরিয়ে যাব, নিজে নিজে হেঁটে।

 

কি খুঁজছেন ? মিহিস্বরে বললেন তিনি 'মেরুদণ্ডখানা' .......একা নয় বহু, বহুজন

 

একই খোঁজে হামা দিচ্ছে এ কোণে ও কোণে ঘর জুড়ে "

 

এই বহুজনের মধ্যে যে রয়ে গেছি , আমি, আপনি বা আপনার পাশের ওই সুখী সুখী মুখের দামি সিগারেট ফুঁকে চলা লোকটি , বা ওই ডাকাবুকো তরুণটি অথবা ওই স্লীভলেস ব্লাউজ আর অতি দামি শাড়ি পরিহিতা মহিলা , বা ধরুন ওই যে আই জি এমের সামনে গাঁজা খেয়ে তূরীয় হয়ে ঝিম মেরে বসে আছে যে রিকশাচালক -সে ও। আসলে আমরা সবাই একেকজন সাত্যকি রায় , শুধু আলাদা আলাদা মুখোশ পরে বসে আছি।

 

নাহ , এমন নয় যে এ খোঁজ খুব প্রকট বা বহির্মুখীন। কোথাও , কোনো মুহূর্তে হটাৎই মনে হয় --ওই যে সাত্যকির স্ত্রী রাগিণীর সংলাপে - 'রেপ করে পুড়িয়ে মেরে দিল মেয়েটিকে' -- আমি কি প্রতিবাদ করলাম ? না কি, নীরবে মেনেই নিলাম ? প্রশ্নটা থেকেই গেল। আর এই প্রশ্ন এলেই অসহায়ত্ব আসে , আর তখনই অবচেতনে শুরু হয় খোঁজ ---খানিক্ষণের জন্য হলেও। মেরুদণ্ডের। সোজা এবং শক্ত পোক্ত একটি মেরুদন্ডের..

 

তবুও, স্বতন্ত্র এক অস্তিত্ব নিয়ে , সবার অজান্তেই সব মধ্যবিত্তের বসবাস , বহুজনের খোঁজের মাঝেও সেখানে সে একাকী , তার খোঁজ শুধু তারই, তার নিজের সেই দৃঢ় এবং সোজা মেরুদণ্ডটির যেটি কোথাও না কোথাও কিভাবে যেনো অজান্তেই হারিয়ে গেছে।

 

আবার কি আশ্চর্য, এ এক অদ্ভুত মনোবিকার যাতে এই অসহায়ত্বের মধ্যেই চাপা রয়ে গেছে এক মুগ্ধতা। সাত্যকি রায় যখন জানতে পারে ধীরে ধীরে তার সেই দ্বৈত সত্তার কথা সবার চোখে পড়ছে, তার পরিবারে এক চাপা টেনশন --উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা তৈরী করছে , তখনো সে এক আশ্চর্য “অল্টার ইগো”-র দাস হয়ে কেমন যেন নিশ্চিন্ত। মনে পরে গ্রেগর সামসাও ঠিক তেমনি এক নিশ্চিন্ততার আবেশে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছিল, নিজের পোকা জীবনকে মেনে নিয়েছিল—যতদিন না মৃত্যু আসে।

 

নবারুণ যেভাবে শঙ্খ ঘোষের 'হামাগুড়ি' কবিতাটিকে চিত্রায়িত করেছে তা এক কথায় অসাধারণ বলা চলে। চোরাবালির ঘোড়সওয়ার সে হতে চায় নি , তার অন্বিষ্ঠ ভিন্ন - কবিকে আশ্রয় করে অন্যভাবে কিছু কথা বলে দিয়ে যাওয়া। এটিতে সে সফল বলতেই হবে। দ্য স্পাইন - ছবিটিতে অভিনয় করেছেন শান্তনু শর্মা , মধুমিতা তালুকদার , শুভঙ্কর চক্রবর্তী, আশুতোষ দে, অরুনাভা ঘোষ , সৌরভ চৌধুরী , প্লাবন দে এবং অনুপ কুমার দেব । চিত্রনাট্য , সংলাপ , নির্দেশনা নবারুণ-এর। প্রত্যেকেই মন প্রাণ দিয়ে অভিনয় করেছেন -- অভিনয় দেখে বোঝা যায় এই কঠিন এক জাদুবাস্তবতাকে , একটি আগাপাশতলা বিমূর্ত কাহিনীকে রূপায়িত করতে , এর যে এসেন্স , এর যে অন্তর্লীন উৎকণ্ঠা, এর যে দুঃস্বপ্ন আর আত্মরতির অভূতপূর্ব অনিশ্চয়তার মিশেল , তাকে তারা সবাই আত্মস্থ করতে শুধু যে পেরেছেন, তাই নয় বাস্তববোধে জারিত রসে তারা বরঞ্চ ফিল্মটিকে এই উচ্চতায় নিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর ছিলেন । এ কাজটি যে কেউই বলবেন এক বিশাল কঠিন কাজ ছিল। আমার ব্যক্তিগত ভাবে , সবার অভিনয়ের বাইরেও যে বিষয়টি মনে দাগ কেটেছে তাহলে ক্যামেরার কাজ , এডিটিং আর গানের ব্যবহার। নবারুণ বলল এসব টেকনিক্যাল কাজ করেছে আমাদের এ রাজ্যের কিছু তরুণ। ভাবতেই ভাল লাগে যে রাজ্যের তরুণ তরুণীরা এত গভীর কাজে শুধু আগ্রহী নয় , তারা তাদের কাজকে অন্যমাত্রায় পৌঁছে দিতে সক্ষমও বটে।

 

তবে একটি দুটি জায়গায় আমার একটু হোঁচট খেতে হয়েছে , স্বীকার করতেই হয়। প্রথমতঃ ফিল্ম শুরু প্রথম দিকেই স্ল্যাং ব্যবহার। এর কোন প্রয়োজন সামগ্রিক কাহিনীর বিচারে ছিল বলে আমার মনে হয় নি , পুরো ব্যাপারটাকেই 'আগরতলী' খিস্তি ব্যবহার করে 'আগরতলা কেন্দ্রিকই করতে হবে এমন কোন মাথার দিব্যি তো ছিল না। আর শান্তনুর মানে সাত্যকির ভারী ভারী ইঙ্গিতধর্মী সংলাপগুলি হয়ত আরেকটু সরলীকরণের সুযোগ ছিল। সম্ভবতঃ সংলাপ লেখক এবং নির্দেশক -এ ক্ষেত্রে নবারুণ - সাসপেন্স তৈরী করার চেষ্টায় এটি করেছেন -কিন্তু তাতে ফিল্মটির সাবলীলতা কে অনেকটাই প্রভাবিত করেছে বলে আমার মনে হয়েছে।

 

সবকিছুর শেষে একটা কথা বলতেই হয় : বৃত্তের বাইরে অন্যধর্মী সিনেমায় ত্রিপুরার যাত্রা সঠিক অর্থেই শুরু হয়ত হল নবারুণের এই Wren Films এর মাধ্যমে। অকপট ভাবে বলা একটু ভিন্ন গল্পের আশায় এ রাজ্যে আমরা এখন অপেক্ষা করতেই পারি, শুধু নবারুণ কেন , আরো অনেকের কাছ থেকেই।

You can share this post!