নন্দিতা দত্ত
মেয়েটার মুখটা শুকনো। আজ ফোন করেই এসেছে, আগে কখনো বাড়ি আসেনি। বিভিন্ন জায়গায় দেখা হয় খুব প্রানবন্ত মেয়ে,কিন্তু আজ একদম চুপচাপ। চা খাবে তো? মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। ভনিতা না করেই বলল দিদি একটা থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন? অবাক হবার পালা।কারন ওকে চিনি প্রসুনের বউ হিসেবে। প্রসুন আমার ভাইয়ের ক্লাস মেট। বলল, দিদি কেন আমি থাকার জায়গা খুঁজছি কারন এখন বলবো না। শুধু জানি আপনার কাছে এলে ফিরে যেতে হবে না। প্রশ্ন করলাম না। দুদিন পর আসতে বললাম। কোন ভাড়া বাড়ি নয়, হোস্টেলে থাকতে চায়। ভাগ্যক্রমে পাওয়া গেল শহরের কাছেই হোস্টেল। দুদিনের দিন বিকেলে এল সাথে ছোটো একটা ব্যাগ। খুব কিছু জিজ্ঞেস করলাম না সময় হলে বলবে। চা খেয়েই ভাঙতে শুরু করলো, বলতে শুরু করলো নিজের করুন কাহিনী।
অনেক মেয়েরাই বিয়েটাকে টিকিয়ে রাখতে চায়না, এই অভিযোগ হামেশা শোনা যায়। কিন্তু কেন? এর পিছনে কি কারন? নারী কি সমানাধিকারের বেশি কিছু চেয়েছে? ভোটাধিকার, শিক্ষার অধিকার,স্বাস্থ্যের অধিকার – সবই সংবিধান অনুযায়ি তার জন্য স্বীকৃত। কিন্তু যা পায়না তা হল মানবাধিকার। যেই অবস্থানেই থাকুন না কেন সেখানে যে ন্যূনতম অধিকার পাওয়ার কথা সেই বোধটাই জন্মায় নি আমাদের মধ্যে। নারীর প্রতি এই মানসিক অবস্থান থেকেই নারীর প্রতি সহিংসতা ক্রমবর্ধমান। আর এও স্বীকার করতে দ্বিধা নেই এর প্রধান কারন পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভংগী। নারী পুরুষ থেকে স্বতন্ত্র হলেও উভয়ে উভয়ের পরিপূরক। নারী প্রতিনিধিত্ব করে সৃষ্টির, প্রকৃতির, স্বাভাবিকতার।
ঘর ভাঙ্গার কথা আজকাল খুব শোনা যায় পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে মেয়েরা রুখে দাড়াচ্ছে বলে। সব হিংসাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে গার্হ্যস্থ হিংসা। কিন্তু কেন বাড়ছে নারী হিংসা? বিশ্লেষণ করলে ঐতিহাসিক-ধর্মীয়-সামাজিক কারণ,পারিবারিক, শ্রম বিমুখতা, প্রকৃতিগত কারণ,পুরুষের প্রধান্য, নারীর আত্মবিশ্বাসের অভাব – ইত্যাদি নানামাত্রিক কারনগুলোর মধ্যে মানবাধিকার বোধ সম্পর্কে সামাজিক অসচেতনার কারনে নারীর প্রতি হিংসা বেড়েই চলেছে। এক প্রজন্মের হাত ধরেই নারীর প্রতি বেড়ে যাওয়া হিংসা কমে যাবে এমনটাও আশা করা যায় না। সীতা সাবিত্রির মত নারীকে হতে হবে এমন ভাবনায় ভাবতে হবে সীতার কোন রূপ? আগুনে আধপোড়া হয়ে স্বামীর ঘরে থাকা? মানবাধিকারের প্রশ্ন তাহলে এখানেই। আর তাই নিয়েই হিংসা বেড়ে চলছে। সেই জন্য প্রয়োজন পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবাপন্নদের প্রকৃত শিক্ষা। আর এই পুরুষ তান্ত্রিকতা যে পুরুষদের মধ্যেই শুধু সীমাবদ্ধ তা ভাবার কারন নেই। সামাজিকভাবে মেয়েদের অনেক ক্ষেত্রেই মনে করিয়ে দেয়া হয় কোনটা মেয়েরা করতে পারবে, কোনটা মেয়েরা পারবেনা। এখনও খাপ পঞ্চায়েত সিদ্ধান্ত নিয়ে মেয়েদের নিজ অবস্থান থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চায় । প্রতিবাদী মেয়ের পরিবারও সমাজের ভয়ে মেয়েটির প্রতি অন্যায় আচরন করে তার মানবাধিকার লঙ্ঘন করে। ভারতীয় ধর্মীয় স্বত্তা নানা বিধিনিষেধের জালে আটকে রেখেছে। বশীকরন,নজর না লাগা, বিজ্ঞান যুক্তির থেকে শত হাত দূরে সরিয়ে ধর্মীয় নির্ভরতায় আটকে রেখেছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যে ভাবেই হোক না কেন। সামাজিকভাবে নারীর মানবাধিকারের চাইতে গুরুত্বপূর্ন পুরুষতান্তিকতা। শুধু কয়েকজন নারীর সামাজিক অবস্থান,নারীর সাফল্যই পালটে দিতে পারেনা। দিনের পর দিন ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো শুনলে বা জানলে মনে হয় সভ্যতার থেকে অনেকটাই পিছিয়ে আমরা।
পুরুষের সমকক্ষ হয়ে নারী অনেক ক্ষেত্রেই এগিয়ে যাচ্ছে এটাও পুরুষের অপছন্দ। নারী পুরুষের মূখাপেক্ষি হয়ে, অনুগত হয়ে জীবন কাটিয়ে দেওয়াই যেন লক্ষ্য হওয়া উচিত। নারী পড়াশুনার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হতে চাইলেও পরিবার গুরুত্ব দেয় বিয়েতে। সেক্ষেত্রে নারীর অবদমিত মন তার অবস্থান সম্পর্কে আত্মবিশ্বাসে থিতু হতে দিতে পারেনা। যদিবা কেউ প্রতিবাদী হতে চায় সেক্ষেত্রে তাকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হতে হয় মানসিক বা শারীরিক নির্যাতনের শিকার। প্রকৃতিগত কারনেও নারী পুরুষের সমকক্ষ নয় বলে নারীর প্রতি অমানবিক আচরন আকছাড় হতে দেখা যায়। সামাজিক বিধিনিষেধের চাপে অনেক ক্ষেত্রে নারীর আত্মমর্যাদা, আত্মসচেতনতার ভিতটাও পোক্ত হয়না, হীনমন্যতায় মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়।
নারী নির্যাতন বাড়ার পেছনে কারন সম্পর্কে বলতে গিয়ে ত্রিপুরা মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সভাপতি মিহির দেব বললেন, নারী নির্যাতন বৃদ্ধি পাচ্ছে যে বলা হচ্ছে তা রিপোর্টিং বৃদ্ধি পেয়েছে। আগে এত মিডিয়া ছিলনা। মানুষ মিডিয়ার কাছে যেতনা। এখন ন্যায়সংগত বিচার পাওয়ার আশায় মিডিয়ার সাহায্য নেয়। নথিভুক্ত ঘটনাগুলোই আমরা জানি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় প্রাকবিবাহ যৌতুক দাবি করা এবং বিবাহ উত্তর সময়ে ক্রমাগত দাবি না পূরনে মানসিক বা শারীরিক অত্যাচার হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেন্দ্রীয় সরকারি পদস্থ আধিকারিকের মতে, স্বাধীনতার নামে স্বেচ্ছাচারিতার বহি:প্রকাশ এবং তারই সুযোগ নিয়ে নারী নির্যাতন বাড়ছে। তার মতে মানসিকভাবে শিক্ষিত হবার প্রয়োজন, আধুনিকতার নামে অশ্লীলতাও নারী হিংসার পেছনে একটি কারন। ভিন্ন মত অন্য এক সরকারী কর্মচারীর। কেউ কারো কথা শোনা প্রয়োজন মনে করেনা, মিডিয়ার একাংশকেও তিনি দায়ি মনে করেন। কোন ঘটনার এত বিস্তৃত বর্ননা হয় যা অনেক ক্ষেত্রে মানুষ সাহস পায় অপরাধ করতে।
হিংসা বেড়ে যাওয়ায় উদবিঘ্ন অনেকেই নিজের মত করে ভাবছেন কি করে কমানো যায় এ ধরনের অপরাধ। অধ্যাপক দেবের মতে সামাজিক বিরোধিতা এধরণের অপরাধ কমাতে পারে। পুলিশের প্রয়াস কর্মসূচি’র কিছু ফল হয়েছিল, স্কুলের ছাত্র ছাত্রীদের সচেতন করতে সামাজিক শিক্ষার প্রয়োজন। পাশাপাশি বিজ্ঞাপন দুনিয়ার একজন বললেন, হিংসা কমার ক্ষেত্রে অভিভাবকদের ভুমিকাও গুরুত্বপূর্ন। বিশ্ব বিদ্যালয় ছাত্র নিতিন বলল, হিংসা বাড়বেই কারন মানুষের চাহিদা এত বেড়েছে। মানুষ লোভী হয়ে পড়ছে, চাহিদা পূরনে হিংসার পক্ষ নিচ্ছে। প্রতি পাড়ার ক্লাব পারে এধরনের অপরাধ কমাতে। খবরের সত্যতা যাচাই করাটাও জরুরি। সঠিক শিক্ষা এই হিংসা কমাতে পারে বলে তার মনে হয়।
শোষনের শৃঙ্খল থেকে লড়াইয়ে পুরুষদেরও ভুমিকা রয়েছে। তাই এযুগের চিত্রাংগদা বিশেষ কিছু চায়না। সে শুধু এটাই চায়, নারীর মর্যাদা রক্ষা করে এবং হিংসার শিকার হতে না চেয়ে এগিয়ে যেতে হবে। লক্ষণ রেখা ডিংগিয়ে যেতে হবে ভবিষ্যতের কথা ভেবে তার সন্তান যেন হিংসার গর্ভে জন্ম না নেয়।
নারী নির্যাতন থেকে কন্টক মুক্ত হওয়ার জন্য আত্মনির্ভরতার প্রথম পাঠ আসবে শিক্ষার হাত ধরে। যার মূল কারন নিহিত থাকবে সামাজিক শিক্ষা সচেতন মননের স্তরে। যাকে এখনো অনুন্নত ও অপরিশীলিত বলা যায়। অর্থ,বিত্ত,সামাজিক, রাজনৈতিক পদমর্যাদার অলংকার দিয়ে অশিক্ষা-অপসংস্কৃতিকে লুকিয়ে রাখা যায়না। এই সামাজিক ব্যাধি নির্মূল করার জন্য প্রয়োজন সামাজিক গোষ্ঠীর সক্রিয়তা। একশভাগ নারীকে শিক্ষার পরিমন্ডলে নিয়ে আসতে পারলে নারীর অবস্থানের উন্নতি ঘটান সম্ভব। এর জন্য রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকেই সবিশেষ নজর দিতে হবে। মহিলারা যেন ন্যায় সংগত ব্যবহার পান, যেখানে লক্ষ্যে অবিচল থেকে কোন নারী কারকের ভূমিকা নিতে পারেন। নারী হিংসার মূলে যে পারবারিক অস্থিরতা, সামাজিক অস্থিরতা তাতে নারী পুরুষের মধ্যে যে বৈষম্য তাতে অহংবোধ,আমিত্বের লড়াই পরিপূরক ক্রিয়াশীল। নারী পুরুষের দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক। এই দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রে দেখা যায় পুরুষ আধিপত্য করে স্বামী, পিতা, পুত্র, প্রেমিক, ভাই হয়েও। তবে পুরুষতান্ত্রিকতার দাপট কমিয়ে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে নারী পুরুষকে হাঁটতে হবে অনেক পথ। নারীর মানবাধিকারের হাত ধরে নারী প্রতি হিংসা কমতে পারে।