Paramita Gharai
September 17, 2018:
পরপর দুটো ক্লাস অফ্ ছিল। ফুটপাতের ওপর চাএর দোকানে আড্ডা দিতে দিতেই কথাটা তুলল মৈনাক। ”চল না এবার বিশ্বকর্ম্মা পুজোয় কোথাও ঘুরে আসি ।” আর্যক, পিয়াসী, ঋতম, শ্রীময়ী আর সাগ্নিক হৈ হৈ করে উঠল। শনি রবি সোম পরপর তিনদিন ছুটি পড়েছে।
”চল তবে দীঘা ঘুরে আসি, বা তাজপুর।” পিয়াসী বলল ।
”হ্যাঁ ঐ দীঘা তাজপুর ছাড়া আর কিছু নেই নাকি?”ঋতম ধমকে উঠল।
”তাহলে শান্তিনিকেতন চল।” সাগ্নিক সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে কথাটা ছুঁড়ে দিল।
আর্যক বলল,”চল তবে কোপাই আর কাশফুল দেখে আসি।”
শ্রীময়ী এতক্ষণ সবকিছু চুপচাপ শুনছিল। বলল , ”তোরা যদি মঙ্গলবার অবধি ছুটিটা বাড়িয়ে নিতে পারিস তবে চল পুরুলিয়া ।”
”কেন ঐ সময়ে কি আছে পুরুলিয়া তে?”মৈনাক আর পিয়াসী একসাথে প্রশ্ন করে।
শ্রীময়ী বলে,”ভাদু পরব।”
”সেটা কি রে?”ঋতম জানতে চায়।
পিয়াসী বলে ,”আরে ভাদুগান আছে জানিস না?”
নানা কথা, তর্কবিতর্কের পর পুরুলিয়া যাওয়াই ঠিক হল।
রবিবার ছ’বন্ধু যখন ট্রেন থেকে বরাভূম স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে নামল তখন ঘড়ির কাঁটার সকাল সাতটা। প্ল্যাটফর্মে ওদের দেখেই এগিয়ে এল এক চা-ওলা। ছ’জনে সঙ্গে সঙ্গে গলা ভেজালো চা দিয়ে । পিয়াসী আর মৈনাক সিগেরেট ধরাল। ওদের ততক্ষণে ঘিরে ধরেছে ভাড়া গাড়ির ড্রাইভাররা। দরদাম করে একটা গাড়ি ঠিক করে রুকস্যাকগুলোকে কোলে নিয়ে সিটে গিয়ে বসল ওরা । দু-একটা পাকাবাড়ি আর টিনের বা টালির চাল দেওয়া দোকান ঘর ছাড়িয়ে পাকা রাস্তা বেয়ে গাড়ি ছুটল বাঘমুন্ডির উদ্দেশ্যে। শরতের নীল আকাশ ভেসে থাকা ছুটি পাওয়া সাদা মেঘের গা বেয়ে সোনালী রোদ তখন ছুঁতে চলেছে ডানদিকে অনতিদূরে শুয়ে থাকা শিশির ভেজা ”মাঠা” পাহাড়কে। তার পাশ থেকেই মাথা বাড়িয়েছে ”পাখি” পাহাড়।
সবুজ পাহাড়ের পায়ের কাছে-দূরে মাথা দোলাচ্ছে কাশের দল। বাঁদিকের গাছগাছালি ঘেরা ফাঁকা জায়গায় মোড়ের দলের চরে বেড়াচ্ছে । ডানদিকে একটা পাকা রাস্তা সবুজ ক্ষেতকে দু’পাশে রেখে সোজা ছুটে গেছে অযোধ্যা পাহাড়ের দিকে। সেই রাস্তা ধরে এগিয়ে আসছে কয়েকজন মেয়ে । মাথায় তাদের রঙিন পুতুল, গান গাইতে গাইতে চলেছে ওরা। মৈনাক চেঁচিয়ে ওঠে, ”কিসের প্রসেশন? ” ড্রাইভার বলল,”ও ভাদু।” শ্রীময়ী বলল, ” ঐ যে মাথায় পুতুলটা দেখছিস, ওটাই ভাদু। সারাদিন কাজের মধ্যে যখন সময় পায় তখন গান করতে করতে ভাদুকে নিয়ে ওরা একবার ঘুরে আসে।”
”গাড়িটা একটু সাইড করুন তো দাদা” , সাগ্নিক ড্রাইভারকে বলে গাড়িটা দাঁড় করালো। তারপর এক দৌড়ে গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে রাস্তা পার হয়ে ভাদুর প্রসেশনের সামনে দাঁড়িয়ে লেন্সের চোখ রাখল। ততক্ষণে সবাই নেমে এসে দাঁড়িয়েছে সাগ্নিকের পাশে। ভাদুর দল ওদের ছেড়ে এগিয়ে চলল ।
খোলা দোকানপাট,বাজার ,লোকজন শুদ্ধ বাঘমুন্ডির মোড় পার হয়ে গাড়ি ঢুকলো একটা বাংলোর দিকে। গাড়ি করে বাংলোর ভেতর কিছুটা রাস্তা পার করে ওরা যখন কেয়ারী করা বাগানের সামনে এসে গাড়ি থেকে নামল, তখন ওদের সামনে তিনতলা গেস্ট হাউস আর পেছনে সবুজ অযোধ্যা পাহাড়।
এক একটা ঘরে দুজন করে থাকার ব্যবস্থা হলেও চা খাবার জন্যে ওরা ছজন একটা ঘরেই বসল। প্রথম মুখ খুলল ঋতম,”তোকে থ্যাংকস শ্রীময়ী। পুরুলিয়া যে এত সুন্দর না এলে জানতাম না।”
”ঠিক বলেছিস” সাগ্নিক বলল, ”আমরা জানতাম পুরুলিয়া অযোধ্যা পাহাড়,রুক্ষ মালভূমি , টিলা আর লাল মাটির জেলা ।”
স্নান সেরে ব্রেক ফাস্ট করে ওরা বের হল মাঠার দিকে। পাখি পাহাড় দেখে যখন ওরা ফিরল তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। লাঞ্চ করে যে যার ঘরে না গিয়ে আড্ডা জমানো মৈনাকদের ঘরে।
”কালকের প্রোগ্রাম তবে কি?” আধশোয়া অবস্থায় ধোঁয়ার রিং উড়িয়ে অ্যাশট্রেতে ছাই ফেলল আর্যক।
শ্রীময়ী বলে উঠল ,”কাল কি রে? আজ সন্ধ্যেবেলাতেও বের হতে হবে তো। ভাদুর গান শুনতে যাব তো। ”
” আজই?” বাকীরা একসাথে জিজ্ঞাসা করে উঠল।
”একটা গল্প বলি শোন তবে ।” শ্রীময়ী বলে চলল।
”বর চলেছে বিয়ে করতে । পালকিতে বরের সাথে বরের বাপ ,বড়ো ভাই। সব মিলিয়ে জনাদশেক বরযাত্রী। সব মিলিয়ে তিনটে পালকি। সঙ্গে দুজন লেঠেল। সকাল রওনা দিয়েছে ওরা । কনে হল পঞ্চকোট রাজার মেয়ে ভদ্রাবতী।”
”ভদ্রাবতী” ,পিয়াসী আওড়ালো নামটা নিজের মনে মনেই।
”সাত সকালে রওনা দিয়ে মানভূমের মালভূমি আর পাহাড় ডিঙিয়ে জঙ্গল মহলের পথ ধরে পালকি চলেছে। পালকি বেয়ারাদের ‘হুহুম না হুহুম না’ ফিরে ফিরে আসছিল পাহাড় থেকে পাহাড়ে । তাড়াতাড়ি পা চালাচ্ছে বেহারাগুলো, সন্ধ্যে নামার আগেই পেরোতে হবে জঙ্গল । কিন্তু দুপুর গড়িয়ে বিকেল হবার মুখে জঙ্গলের সামনে এসে দাঁড়ালো বর যাত্রীর দল। ঠিক হল রাত ভোর হলে ওরা আবার রওনা দেবে। সেইমতো দুটো ভাত ফুটিয়ে নেবার আয়োজন হল। তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়তে হবে। পরদিন খুব ভোরে রওনা দিতে হবে যে। সবে মাত্র দু-গাল ভাত মুখে তুলেছে বেহারাগুলো , একটা অদ্ভুত শব্দে সবাই চমকে উঠল।”
”বাঘ নাকি রে?” ঋতম গোল গোল চোখ করে জিজ্ঞেস করল।
শ্রীময়ী বলতে লাগল,”না পাখির শিস্। সেই শিস শুনে বেহারাগুলোর চোখেমুখে আতঙ্ক ফুটে উঠল। ভাতের থালা ফেলে ওরা ছুটে পালাল জঙ্গলের মধ্যে।বরযাত্রীর দল কিছু বুঝে উঠবার আগেই ‘হারে রে রে রে রে’! করে ঝাঁপিয়ে পড়ল ডাকাতদল ।”
” ডাকাত?” চেঁচিয়ে উঠলো ঋতম,”কি বলিস রে?”
”চুপ কর তো। শুনতে দে।” আর্যক এক ধমক দেয়। ঋতম ততক্ষণে উত্তেজিত হয়ে সোফা ছেড়ে বিছানায় উঠে এসে বসেছে।
মৈনাক ওকে জায়গা দিয়ে পাশে সরতে সরতে বলে উঠল,”বল,বল।”
শ্রীময়ী আবার শুরু করল ,” ভদ্রাবতীর গায়ে হলুদ শেষ। ছাঁদনা তলায় আঁকা হচ্ছে বিয়ের আলপনা । রান্না ঘরের পাশের খোলা উঠোনে সামিয়ানা টানিয়ে চলছে আপ্যায়নের তোড়জোড়। দপ্তরীখানায় বসে গড়গড়া মুখে নায়েবের সাথে বরকে বরণ করার তোড়জোর করছিলেন রাজা নীলমণি সিংদেও । বজ্রপাতের মতো খবরটা এল সে সময়ই। বর ও বরযাত্রী সকলেই ডাকাতদের হাতে নিহত হয়েছে। নহবত থেমে গেল। ”
”ইসসস্, ” কঁকিয়ে উঠল পিয়াসী ।
”তাহলে ভদ্রাবতীর কি হল?” ঋতম জানতে চায়।
শ্রীময়ী বলল,” শোকে স্তব্ধ রাজপরিবারের আরো কিছু শোক পাওনা ছিল। পরদিন ভোর বেলা পাওয়া গেল রাজকন্যা ভদ্রাবতীর নিথর দেহ।” শ্রীময়ী এবার হাসল। বলল,” সবটাই কিন্তু কিংবদন্তী।”
আর্যক কোলের বালিশটা বিছানার ওপর ছুঁড়ে বলল, ”যাঃ শালা!”
ঋতমের দিকে তাকিয়ে শ্রীময়ী বলল ,” ইতিহাস বলে পঞ্চকোটের রাজা নীলমণি সিংহের ছিল তেরটি ছেলে। তাঁর কোনো মেয়ের খবর পাওয়া যায় না। আর যদি কোন মেয়ে থেকেও থাকে তার নাম ভদ্রাবতী কিনা জানা নেই ।”
– ”বস্ তুই হিস্ট্রি না নিয়ে কমপারেটিভ লিটারেচার পড়ছিস কেন রে?” ঋতম বলে উঠল।
পিয়াসী বলে উঠল,”চুপ কর না। শুনি। এই শ্রীময়ী বলতো।”
শ্রীময়ী টেবিল থেকে জলের বোতলটা তুলে জল খেয়ে নাকের ওপর ঝুলে পড়া চশমাটা ডানহাতের তর্জনী দিয়ে ঠেলে ওপরে তুলল।
ঋতম বলল,” আরে বস্ শেষ করো।”
শ্রীময়ী আবার শুরু করল।
”আর একটা কিংবদন্তী আছে। ছাতনা রাজার সাথে পঞ্চকোটের রাজার যুদ্ধ হয়েছিল ভাদ্রমাসে। তাতে পঞ্চকোটের রাজা জয়ী হন। সেই বিজয়কে মনে রেখেই নাকি ভাদু উৎসব।”
সাগ্নিক ক্যামেরা নিয়ে খুটখুট করতে করতে বলল,” আমি একটু অন্যরকম শুনেছি।”
ঋতম আর মৈনাক বলল,” বস্ , তুমিও!”
শ্রীময়ী সাগ্নিক কে বলে ,”শুনি তোরটা।”
সাগ্নিক ক্যামেরাটা পাশে সরিয়ে রেখে শুরু করল,” পঞ্চকোটের একটা গ্রামের নাম ছিল লাদা। সেখানকার মোড়লের মেয়ে ভদ্রাবতী । ডাক নাম ভাদু। তার পরিশ্রমের গুণে জমিতে ধান নয় ,যেন সোনা ফলত। রাজা ধ্রুবচাঁদ দত্তক নিতে চান ভদ্রাবতীকে। মোড়ল রাজী হলেন না মেয়েকে কাছ ছাড়া করতে। রাজা তখন ভাদুর শিক্ষাদীক্ষার দায়িত্ব নিলেন।”
”বাহ্” মৈনাক মন্তব্য করে।
”ইতিমধ্যে ইংরেজদের সাথে যুদ্ধ বাঁধে। যুদ্ধে রাজা বন্দী হন। ততদিনে ভাদু বড়ো হয়ে উঠেছে। পাশের গ্রামের অঞ্জন বলে একটি ছেলেকে ভাদু ভালোবাসত। ধ্রুবচাঁদ মুক্ত হয়ে ফিরে এসে শোনেন অঞ্জনের কথা। রাজা অঞ্জনের সাথে ভাদুর সম্পর্ক মেনে নিতে পারলেন না। অঞ্জনকে বন্দী করলেন।”
”ধুর ” পিয়াসী চোখ কুঁচকালো।
”অঞ্জনকে দেখবার আশায় দিনরাত কারাগারের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করত ভাদু। তাই দেখে রাজার মন নরম হয়। অঞ্জনকে মুক্তি দেন। কিন্তু ভাদুর আর খোঁজ মেলেনা। সে হারিয়ে যায় চিরদিনের মতো।”
”সেকি বিয়েটা হল না? ভাললাগে না”,মৈনাক মতামত দিল।
পিয়াসী ফিক করে হেসে উঠল,”তোর ভাললাগা অনুযায়ী কি ইতিহাস তৈরী হবে।”
”তোরা কি এখন ঝগড়া করবি? চল তৈরী হয়ে নিই। শ্রীময়ী এবার কোথায় নিয়ে যাবে দেখি।” আর্যক বলল।
”তোরা মেয়েরা চোখেমুখে রঙচঙ মাখার হলে মেখে নে। আমরা তো জিন্স পরেই আছি। ” মুখে সিগেরেট ঝুলিয়ে ক্যামেরায় চোখ দিয়ে সাগ্নিক বলল। শ্রীময়ী কটমটিয়ে ওর দিকে তাকাতেই ”ক্লিক্।”
পিয়াসী চেঁচিয়ে উঠলো, ”আমি বাদ?”
গাড়িতে বসে শ্রীময়ী বলল,”বাঘমুন্ডি গ্রামে যাব।আজ ভাদ্রসংক্রান্তির আগের দিন। আজ হবে ভাদুর জাগরণ। আমরা আজ সেটা দেখতেই চলেছি।” কথায় কথায় গাড়ি এসে থামল কয়েকটা মাটির বাড়ির সামনে । গ্রামে ঢুকবার জন্য গাড়ি থেকে নামল ওরা। রঙিন টুনি আর টিউবের আলোয় সাজানো একটা বাড়ির উঠোনে এসে থামল। মাইকে কান ফাটানো হিন্দী গান বাজছিল। ওদের ছ’জনকে আসতে দেখে উপস্থিত স্থানীয় লোকজন একটু অবাকই হল। শ্রীময়ী বলল, ”একটু দাঁড়া তোরা।” গটগটিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল শ্রীময়ী । বাকি পাঁচজন দাঁড়িয়ে রইল উঠোনে। বেশ কিছু পরে একটি লোকের সাথে বের হয়ে এল। শ্রীময়ী বলল, ”কাকু ওরাই আমার বন্ধু। ওদের কথাই তোমাকে বলেছিলাম।” ওদের দিকে এসে হাতজোড় করে পরিচয় দিল তাঁর নাম অশোক মাহাতো, গ্রামের সরকারী স্কুলের মাস্টার মশাই। অস্বস্তি কাটিয়ে মৈনাক বলল যে ওরা ভাদুর জাগরণ দেখতে এসেছে। শ্রীময়ী বলল,”কাকু ওদের আমি ভাদুর গল্পটা বলেছি।” মাঝারি উচ্চতার বছর পঞ্চাশের কালো মানুষটির মুখে সারল্যের হাসি। বললেন,”তুমরা সব ঘরে এসো।”
গোবর নিকানো উঠোনে রঙিন কাগজের ঘরে হলুদ রঙের শাড়ি পরে পদ্মফুল হাতে ভাদুর মূর্তি সাজানো। পাশে একটা সরায় গোবর আর সরাটা ফুল দিয়ে সাজানো । সামনে একটা থালায় জল মিষ্টি রাখা। বাড়ির মাটির দেওয়াল আর পাঁচিলে খড়িমাটি আর গেরিমাটি দিয়ে যত্নে আঁকা আলপনা। সাগ্নিকের ক্যামেরার সাটার তখন ব্যস্ত গ্রামবাংলার সংস্কৃতিকে লেন্সবন্দী করতে।
ওরা সামনে পাতা শতরঞ্জির ওপর বসল।
আর্যক পিয়াসী আর ঋতমের কানে কানে বলল,” শ্রীময়ী কিন্তু দারুন সারপ্রাইজ দিল মাইরি।”
অশোক মাহাতো বললেন,” আগে কোনো মূর্তি পুজো হতো না । কেবলমাত্র সরাই থাকতো। আসলে নীলমণি সিংদেও র কোনো বিটিই ছিল কিনা তাই তো ইতিহাসে লিখা নাই।” মাস্টারমশাই এর কথায় রাঢ় বাংলার সুর।
মৈনাক প্রশ্ন করে ,” রঘুনাথ সিং দেও কি কিংবদন্তী চরিত্র নাকি তার ঐতিহাসিক সত্যতা আছে?”
অশোক মাহাতো পুরুলিয়ার ভাষায় বলে চললেন, ”১৮৪১ সালে পঞ্চকোটের রাজা হন নীলমণি সিংদেও । তাঁর রাজধানী ছিল কেশপুর ।”
”তার মানে নীলমণি সিংদেও সত্যি ছিলেন” আর্যক বলে।
”সিপাহী বিদ্রোহের আগুন আছড়ে পড়েছিল আমাদের পুরুলিয়াতেও। ১৮৫৭ সালের ৫ই অগস্ট লুঠ হয় ট্রেজারি , জেলখানা ভেঙে তিনশো বন্দীকে মুক্ত করে বিদ্রোহীরা। ইউরোপীয়ান অফিসাররা রানিগঞ্জে পালিয়ে প্রাণ বাঁচায়। ”
”জানতাম না তো” ঋতমের চোখে উত্তেজনা।
”পুরুলিয়া উদ্ধারে অভিযান শুরু হয় ১১ই সেপ্টেম্বর । মানভূমের সাঁওতালদের হাতে অস্ত্র তূলে দিয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন নীলমণি সিংদেও ।”
”সাঁওতালদের এক করে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন! ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে । তারপর।?” ঋতম আর বসে থাকতে না পেরে উঠে দাঁড়ালো।
” তারপর আর কি? নভেম্বর মাসে কাশীপুর অবরোধ করে ইংরেজ বাহিনী। নীলমণি সিংদেও বন্দী হলেন। প্রথমে শান্তিপুর ,তারপর সেখান থেকে তাঁকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়।”
আরো অনেক কিছু বলে গেলেন মাস্টার মশাই।তাঁর সারল্যমেশানো ঝরঝরে পুরুল্যা ভাষায় ছ’বন্ধুর চোখের সামনে ইতিহাস জীবন্ত হয়ে উঠল।
কথায় কথায় রাত আটটা বেজে গেছে। ততক্ষণে অল্পবয়সী মেয়েরা ভিড় জমির ভাদুর মূর্তির সামনে। তারা সেজেছে রঙ বেরনোর শাড়িতে, কপালে তাদের লাল টিপ, হাতে সোনালি চুরি, খোঁপায় রঙিন ফুল আর পাতার সাজ। উঠোন জুড়ে তখন তাদের কথা আর হাসি ঝরে পড়ছে।
”কাশীপুরের রাজার বিটি বাগদী ঘরে কি কর।
হাতের জালি লয়ে কাঁখে সুখ সায়রে মাছ ধর।।
মাছ ধরণে গেলে ভাদু ধানের গুছি ভেঙে না ।
একটি গুছি ভাঙলে পরে পাঁচটি সিকা জরিমানা ।।”
না কোনো মন্ত্র নেই এই পুজোতে। মেয়েরা কেবল গেয়ে যাবে একটার পর একটা গান। আর্যক, মৈনাক ,পিয়াসী ,ঋতম আবিষ্ট হয়ে শুনছে সেই গান। সাগ্নিক ক্যামেরা লেন্সে চোখ দিয়ে খুঁজে নিচ্ছে ওর ছবি । শ্রীময়ী বসেছে গানের দলের পাশে। হাতে ইলেকট্রনিক রেকর্ডার। কিছু কিছু গানে গলাও মেলাচ্ছে শ্রীময়ী । রাজনীতির ছোঁয়া নেই গানগুলোতে। নেই অশ্লীলতা, নারী পুরুষের প্রেম। শহুরে সংস্কৃতি,বাজার চলতি চটুল গান ছুঁতে পারেনি ভাদুর গানকে। এই গানে আছে নারীর সংসার জীবন, তাঁর বেঁচে থাকার কথা, ঘরের আদুরে মেয়ের গল্প , আছে আমাদের এই পোড়া দেশের কন্যসন্তানের মঙ্গলকামনার কথা। একমাস ধরে পুরুলিয়া, বীরভূম, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর সহ রাঢ়ভূমির গ্রামগুলো ভাদ্রমাসের প্রতিটি সন্ধ্যেবেলায় শুনেছে ভাদুর গান। আজই শেষ দিন।
গানের সুরে বিভোর সারা বাড়ি। গান শুনতে শুনতে ওখানে বসেই হাতে ভাতের থালা তুলে দিয়েছিলেন শিক্ষক অশোক মাহাতো। তাঁর বাড়ির উঠোনেই যে ভাদুর পরবের আয়োজন ।
ভোরের আলো ধীরে ধীরে উঁকি মারছে খড়ের চালের ওপর দিয়ে , মোরগ ডেকে উঠল,”কোঁকড় কোঁক” ।
উলু দিয়ে ভাদুর মূর্তিকে কোলে তুলে নিল একটি মেয়ে । আর একজন হাতে নিল গোবরডাঙা সরা। শিশির ভেজা শরত ভোরে তখনো শুকতারা উঁকি দিচ্ছে । শান্ত নীল আকাশে সাদা মেঘেরা স্থির হয়ে দেখছে ভাদুকে। পেছনে পড়ে রইলো রঙিন কাগজের মণ্ডপ, শাকপাতা আর কিছু বাসিন্দা ফুল। মেয়েরা সার বেঁধে চলল বামনী নদীর দিকে, যাবতীয় সামাজিক বঞ্চনাকে অতিক্রম করে ওরা যেন হেঁটে চলেছে নতুন সূর্যের দিকে। পাহাড়ের পায়ে চলা সরু রাস্তা বেয়ে কিছুটা উঠে জঙ্গলের মাঝে বামনী নদী। ধীরে ধীরে জলে ভাসিয়ে দেওয়া হল ভাদু।
আর সেই সঙ্গে ডুকরে কেঁদে উঠলো শ্রীময়ী ।
অশোক মাহাতো ততক্ষণে জড়িয়ে ধরেছে ওকে। ”কাইনছিস ক্যানে বোলতো তুই। পিতিবার তুকে বলি আমি তো আইছি বিটি, তুর বাপ। তুই হামার ভাদু। তুহার লাগেই তু ভাদু ভাসাই ।”
মৈনাক, ঋতম, পিয়াসী, আর্যক হাত রাখে শ্রীময়ী র পিঠে। অনাথ আশ্রমে বড় হওয়া শ্রীময়ী ভাদুর সময় ঘুরে ফিরে আসে এই বাঘমুন্ডি গ্রামে, অশোক মাহাতোর বাড়ি, ওর বাবার খোঁজে। সাগ্নিকের লেন্স ততক্ষণে বন্দী করেছে
বাপ-বিটিকে, পেছনে শরতের সোনালী রোদের ছটায় সূর্যোদয়ের খবর।