আজ সকাল থেকেই সুলতার মন আনচান করছিল, বার বার টেলিফোনের কাছে গিয়েও ফিরে আসছেন। কয়েকবার মোবাইল ফোনের বোতামও টিপেছেন। কিন্তু ওপার থেকে সারা পাননি, কি জানি মনটা কেন এমন অস্থির হয়ে উঠছে আজ? কোনো অশুভ কিছু হয়ে গেলো না তো? অস্থির পায়ে পুজোর ঘরে গেলেন সুলতা।
স্বামী গত হওয়ার পর থেকে একমাত্র ছেলেকে মানুষ করেছেন নিজের মতন করে। কষ্টের সংসার ছিল, কিন্তু ছেলের পড়াশুনায় কোনোদিন ছেদ পড়তে দেননি। আজও সারা দিনের কাজ কর্ম খাওয়া এসবের মাঝেও ছেলের কথা বারে বারে মনে পড়ে সুলতার। সে কেমন আছে, কি করছে, ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করছে কিনা খোকা … এসব তো এখন তার নাগালের বাইরে । বড় হওয়ার পর চাকরি সূত্রে ভিন রাজ্যে চলে যেতে হয়। মনকে সামলেছিলেন ছেলের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা ভেবে। যথা সময়ে বিয়েও দিয়েছেন ছেলের। বৌমাকে নিয়ে ভিনরাজ্যে খোকার সংসার। নিজে রয়ে গেছেন ছেলেরর বাবার তৈরি একতলা ভিটে বাড়িতেই।
খোকা অনেকবার বলেছে “মা চলো আমরা তিনজন একসাথে থাকবো” । কিন্তু কিছুতেই নিজের বাড়ি, স্বামীর স্মৃতি ছেড়ে যেতে মন চায়নি। সময়ের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছেন, নিজের একাকীত্ব কাটাতে নানান রকম হাতের কাজ করেন সময় পেলেই। আর ফাঁকে ফাঁকে একটু টিভি দেখেন। খবর দেখার খুব নেশা। ওটা অবশ্য ওনার স্বামীর থেকে পাওয়া। সুলতার বেশ মনে পড়ে টিভির সব খবর দেখতেন খোকার বাবা। আর সকালবেলা চা খেতে খেতে কাগজ পড়তেন রান্না ঘরের দরজার পাশে একটা জলচৌকির ওপরে বসে। বেশ জোরে জোরে পড়তেন যাতে রান্না করতে করতে সুলতা সব শুনতে পায়। খোকা যখন একটা দুটো কথা বলতে শুরু করল সেও তার বাবার পড়া খবর আওড়াতে থাকতো। হেসে ফেলতেন খোকার বাবা। তারপর খবরের কাগজ রেখে খোকাকে নিয়ে খেলতে শুরু করতেন।
পুরোনো ছবিগুলো মাঝে মাঝেই খুলে দেখেন সুলতা। সেই সময় গুলো ভাবলে নিজের অজান্তেই চোখের কোনটা চিক চিক করে সুলতার। সপ্তাহে একদিন তিনজনে বেরিয়ে পড়তেন কলকাতা শহরে কোনোদিন কালীঘাট, কোনোদিন দক্ষিণেশ্বর, কোনোদিন ভিক্টরিয়া, আর কিছু না হলে গড়ের মাঠ কিংবা চিড়িয়াখানা। খুব দিল খোলা মানুষ ছিলেন। টাকা পয়সা জমিয়ে রেখে যেতে পারেননি। কিন্তু জীবিত সময় বউ আর ছেলের কোনো আনন্দে ত্রুটি ঘটতে দেননি।
আজকাল একটু কাজ করলেই হাঁপিয়ে পড়েন সুলতা। বয়েস বাড়ছে, লকডাউন হওয়ার পর ছেড়েছেন কাজের লোক, নিজেই সব কাজ করেন। কদিন ধরেই টিভিতে ছড়িয়ে
পড়েছে মারণ রোগের কথা। করোনায় আক্রান্ত সারা ভারতবর্ষ। ট্রেন বাস সব বন্ধ।
হাজার হাজার লোক মৃত্যু ভয় উপেক্ষা করে পায়ে হেঁটে ফিরে যাচ্ছে নিজেদের বাড়ী। কি ভয়ানক সে দৃশ্য, কোথাও শ্রমিকরা রাতের অন্ধকারে কাটা পড়ছে রেল লাইন এ, কোথাও হাজার মাইল হাঁটার কষ্ট সহ্য না করতে পেরে রাস্তায় অসুস্থ হয়ে পড়ছেন মানুষ। যতবার টিভি তে খবর দেখছেন, ততবার মন হয়ে পড়ছে উতলা। রোজ বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা আর পাল্লা দিয়ে মৃত্যুসংখ্যা। পৃথিবীর তাবড় তাবড় দেশগুলো পর্যন্ত এই রোগ সামাল দিতে নাজেহাল হয়ে যাচ্ছে ।
কাল রাতে খোকার সঙ্গে কথা হয়েছে। তখন জানতে পেরেছেন আজ থেকে ওদের কাজ শুরু। তাই ফিরে যেতে হবে ওদের কাজের জায়গায়। সেটা শোনার পর থেকেই এক অজানা আশঙ্কাতে মনটা আনচান করছে সুলতার।
সকাল থেকে অনেকবার চেষ্টা করেও কথা হয়নি ছেলের সঙ্গে। দুপুর নাগাদ বৌমাকে ফোনে করে জানতে পারলেন খোকা সকালেই বেরিয়ে গেছে কাজের জায়গায়। কিন্তু তারপর থেকে আর যোগাযোগ নেই। এমনকি পৌঁছানোর খবরটুকুও খোকা দেয়নি। বৌমা অনেকবার চেষ্টা করেছে । কিন্তু ফোন বাজছে না । জানাচ্ছে খোকার ফোন নাকি নেটওয়ার্ক অঞ্চলের বাইরে ! বিকেলে একটু চা খাওয়ার অভ্যেস, চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে অন্য দিনের মতো বারান্দায় বসলেন সুলতা। অন্যদিন সামনের রাস্তায় দিকে চেয়ে থাকেন, পরিচিত কেউ যেতে দেখলে কথাও বলেন। আজ চুলও বাঁধেন নি।বারান্দাতে বসে ইচ্ছে করছিল না কারুর সঙ্গে কথা বলতে। একটু দূরে কৃষ্ণচূড়া গাছটা দেখছিলেন আনমনে। হঠাৎ একটা অ্যাম্বুলেন্স এর আওয়াজ এগিয়ে এলো বাড়ির দিকে। একটু দূরে মনিমালাদের বাড়ির সামনে এসে থামলো গাড়িটা। মনিমালার , সুলতার পুরোনো বন্ধু। দু’মাস আগে পরে ওরা বৌ হয়ে এসেছিল এই পাড়াতে। মনিমালা আগে, সুলতা পরে। তাই সমবয়সী দুই বঁধুর ভাব হতে সময় লাগে নি। দুজনের একসাথে শীতের দুপুরে ছাদে বড়ি দেওয়া , গল্প করতে করতে উল বোনা, আচার বানানো, সিনেমা দেখা ছিল সময় কাটানোর উপায়। তারপর দুজনেই মা হল। ব্যস সংসার জীবনে ও ওদের বন্ধুত্বে ছেদ পড়ে নি। কিন্তু বয়সের ভারে এখন দুজনেরই হাঁটা চলার সমস্যা । তাও মাঝে মাঝে দেখা হত। বিশেষ করে রবিবার সন্ধ্যেবেলা নিয়মিত করে পাড়ার মন্দিরে দুজনেই যেতেন। কিন্তু লকডাউনের জেরে এখন গৃহবন্দী দুজনেই। মোবাইল ফোনে অল্পস্বল্প কথা হয় কেবল। কিন্তু তাতে কি মন ভরে?
বাড়ির ভেতরে থেকে কেউ একজন এসে মনে হলো উঠলেন অ্যাম্বুলেন্সএ। মুখে মাস্ক আর গায়ে পিপিই পরা কিছু লোক তাকে নিয়ে চলে গেল। কার কি হল ওদের বাড়িতে? মনিমালা সুস্থ আছে তো! নিজের হৃৎপিন্ডের শব্দটি বেশ জোরে শুনতে পারছে মনিমালা। অ্যাম্বুলেন্স এর আওয়াজ মিলিয়ে যেতেই আবার নিস্তব্ধ হয়ে গেল পাড়াটা। কৃষ্ণচূড়ার ফুলে ছেয়ে আছে ওদিকটায়। চা কখন যেন ঠান্ডা হয়ে গেছে খেয়াল নেই, মনকে কিছুতেই যেন নিজের কাছে রাখতে পারছেন না। খোকা একবার তো ফোনে করতে পারতো! কি জানি কেমন আছে ?
অভ্যেস মতো সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালালেন সুলতা। শাঁখে ফুঁ দিলেন। কপালে জোড়হাত ঠেকিয়ে ধীর পায়ে ঘরের ভেতর এসে বসলেন। অন্যদিন মনে মনে ঠাকুরের সঙ্গে কত কথা বলেন, খোকা আর বৌমার জন্য কত প্রার্থনা করেন। কিন্তু আজ ঠাকুর প্রণাম ও করলেন আনমনে, অভ্যাসবশতঃ।
টিভির রিমোট টেবিলের থেকে আর নিতে ইচ্ছে করলে না সুলতার। অন্যদিন এই সময়টা হাতের কাজ গুলো সেরে ফেলেন । আজ সেটাও হলো না। একটু জল খেলেন । হঠাৎই মনে পড়ে গেল নোটবুকটার কথা। ঘরে গিয়ে একটা ছোট্ট নোটবুক বের করলেন দেরাজের ড্রয়ার থেকে । খোকা এবার যাবার সময়ে এটা দিয়ে গেছে। এই নোটবুক সব জরুরী ফোন নম্বর লেখা। তার মধ্যে একটা আছে খোকার এমার্জেন্সি নম্বর । খোকাকে ফোনে না পেলে তখন একটা বিশেষ নম্বরে খোকা ফোন করতে বলেছিল। সেই নম্বরটা খুঁজে বের করলেন সুলতা। সেই নম্বরে ফোন করলেন। অনেকবার চেষ্টা করে কিছুতেই সে নম্বরে যোগাযোগ করা গেলো না । বারবার শোনাচ্ছে ফোন নেট ওয়ার্ক এরিয়ার বাইরে। বারান্দার চেয়ারে এসে বসলেন ।
বৌমাকে আর একবার ফোন করবেন নাকি? যদি বৌমা ব্যস্ত থাকে? রাস্তাতে থাকে? থাক্ একটু পরেই ফোন করে দেখবেন। বাইরে তখন অন্ধকার। শুনশান রাস্তার আলোটা একটা ধোঁয়াটে চাদরে মুড়েছে নিজেকে। খুব গরম লাগছে। ঘরে পাখা চালিয়ে বসবেন বলে উঠে দাঁড়ালেন সুলতা। চারদিকে কেমন গুমোট ভাব।জলের বোতল থেকে একঢোক গলায় ঢাললেন।
ঠিক সেই সময়ে, ফোনের কর্কশ আওয়াজ এ নীরবতা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি জল খেতে গিয়ে বিষম খেলেন সুলতা। পা চালিয়ে ফোনটা ধরলেন । ওপাশে ভেসে এলো বউমার গলা। বললো, খোকার সঙ্গে তার কথা হয়েছে , সে ঠিক আছে, আর মাকে চিন্তা করতে না করেছে সে। আরো কিছু কথার পর ফোনটা রাখতেই এতক্ষণ জমিয়ে রাখা উৎকণ্ঠা, অভিমান যেন একদলা কান্নার মতন নেমে গেল সুলতার বুকে। অন্ধকার বারান্দায় কোলের উপর এসে পড়া আলোটাকে পরম মমতায় জড়িয়ে নিলেন নিজের আঁচলে। শীত শেষের পাতার মতন ঝরে পড়া একাকীত্ব গ্রাস করলো সুলতাকে।