• Contact us
  • Advertising Policy
  • Cookie Policy
  • Disclaimer
  • Privacy Policy
  • Terms of Use
Wednesday, September 10, 2025
26 °c
Agartala
enewstime
  • Home
  • News
    • Northeast
    • National
    • International
    • Tripura News
  • Sports
    India’s rifle and pistol mixed teams miss out on medal in Ningbo

    India’s rifle and pistol mixed teams miss out on medal in Ningbo

    'Belief and hard work sets Alireza apart from others': BC Ramesh on star raider after Bulls down Steelers

    'Belief and hard work sets Alireza apart from others': BC Ramesh on star raider after Bulls down Steelers

    Alcaraz takes commanding lead in year-end No. 1 race

    Alcaraz takes commanding lead in year-end No. 1 race

    Kean inspires Italy in thriller, Kosovo stun Sweden in FIFA World Cup qualifiers

    Kean inspires Italy in thriller, Kosovo stun Sweden in FIFA World Cup qualifiers

    Siraj, Henry, Seales nominated for ICC Men’s Player of the Month award for August

    Siraj, Henry, Seales nominated for ICC Men’s Player of the Month award for August

    Satwik-Chirag to spearhead India's challenge in Hong Kong Open

    Satwik-Chirag to spearhead India's challenge in Hong Kong Open

    'Magical night that I will never forget': Merino on scoring first hat-trick

    'Magical night that I will never forget': Merino on scoring first hat-trick

    US Open: Alcaraz beats Sinner to clinch men's singles title and world No. 1 crown

    US Open: Alcaraz beats Sinner to clinch men's singles title and world No. 1 crown

    CAFA Nations Cup: 'Hard work and belief' has carried India into play-off, says Jamil

    CAFA Nations Cup: 'Hard work and belief' has carried India into play-off, says Jamil

  • Business
  • Entertainment
  • Health
  • Features
  • TendersNew
  • More
    • Old Archive
No Result
View All Result
  • Home
  • News
    • Northeast
    • National
    • International
    • Tripura News
  • Sports
    India’s rifle and pistol mixed teams miss out on medal in Ningbo

    India’s rifle and pistol mixed teams miss out on medal in Ningbo

    'Belief and hard work sets Alireza apart from others': BC Ramesh on star raider after Bulls down Steelers

    'Belief and hard work sets Alireza apart from others': BC Ramesh on star raider after Bulls down Steelers

    Alcaraz takes commanding lead in year-end No. 1 race

    Alcaraz takes commanding lead in year-end No. 1 race

    Kean inspires Italy in thriller, Kosovo stun Sweden in FIFA World Cup qualifiers

    Kean inspires Italy in thriller, Kosovo stun Sweden in FIFA World Cup qualifiers

    Siraj, Henry, Seales nominated for ICC Men’s Player of the Month award for August

    Siraj, Henry, Seales nominated for ICC Men’s Player of the Month award for August

    Satwik-Chirag to spearhead India's challenge in Hong Kong Open

    Satwik-Chirag to spearhead India's challenge in Hong Kong Open

    'Magical night that I will never forget': Merino on scoring first hat-trick

    'Magical night that I will never forget': Merino on scoring first hat-trick

    US Open: Alcaraz beats Sinner to clinch men's singles title and world No. 1 crown

    US Open: Alcaraz beats Sinner to clinch men's singles title and world No. 1 crown

    CAFA Nations Cup: 'Hard work and belief' has carried India into play-off, says Jamil

    CAFA Nations Cup: 'Hard work and belief' has carried India into play-off, says Jamil

  • Business
  • Entertainment
  • Health
  • Features
  • TendersNew
  • More
    • Old Archive
No Result
View All Result
enewstime
  • Home
  • News
  • Sports
  • Business
  • Entertainment
  • Health
  • Features
  • Tenders
  • More
Home Art & Culture

মুক্তি

ENEWSTIME Desk by ENEWSTIME Desk
May 12, 2018 - Updated on July 18, 2025
in Art & Culture, Old Archive
মুক্তি
30
VIEWS
Share on FacebookShare on Twitter

Paramita Gharai

ADVERTISEMENT

May 12, 2018:

১

চার ফুট বাই চার ফুট ঘরটার কোনে যে মেয়েটা ঘাড় গুঁজে বসে আছে তাকে আমার  একেবারেই অচেনা। সাদা সালোয়ার কামিজে জড়িয়ে থাকা একটা দোমড়ানো মোচড়ানো শরীর যেন জীবনীশক্তির শেষটুকু জোর করে কোনো রকমে ধরে রেখেছে। পরিচর্যাহীন রুক্ষ চুলগুলো দুটো বিনুনী  করে বাঁধা। ঠিক তেমনই বেড়ির বাঁধনে আটকা ওর পায়ের পাতাদুটো। ক্ষিপ্র শ্বাপদকে যেন পোষ মানানোর তাগিদে খাঁচায় ভরে শিকল পরানো হয়েছে। পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে ক্লান্ত, দুর্বল শরীরটা যেন মিশে যেতে চাইছে ঐ চারফুট বাই চারফুট বদ্ধ খুপরিটার মাটির সাথে। আমার পাশে দাঁড়ানো জেলার সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলাম,”ইয়ে তো মা বননেওয়ালি থি?”
কথাটা শুনে জেলার মুচকি হেসে বলল,”খালাস হ গায়া।”
মুহূর্তের মধ্যে শিরদাঁড়ায় ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। আমি জিজ্ঞাসু চোখে প্রশ্ন করলাম , ”মতলব, ক্যায়সে?”

একবার মুখ তুলে চাইলো জানকী।
শূন্য চোখের দৃষ্টি দিয়ে একবার দেখল আমাকে। ক্ষনিকের জন্যই চোখ দুটো জ্বলে উঠে নিভে গেল।
জেলার সাহেব বললেন,”চালিয়ে মিঃ চৌধুরি।”

ADVERTISEMENT

আমি জেলারের সাথে পা বাড়ালাম। একবার নজর পড়ল জানকীর দিকে। পাংশু বিবর্ণ শুকনো ঠোঁটদুটো একবার যেন কেঁপে উঠলো।

২

ঠিকাদারি সংস্থার চাকরী নিয়ে এসে পড়ছি ঝাড়খন্ডের এই রুক্ষ শুকনো গ্রামে। গ্রামের নাম কোসমা, কোডারমা স্টেশন থেকে প্রায় ষাট কিলোমিটার দূরে এক অখ্যাত গ্রাম। মালভূমির লালমাটির ওপর জঙ্গল ঘেরা গ্রামটার মানুষ গুলো  খুবই গরীব। আমি, বিনয় আর দীনেশ প্রায় একসঙ্গেই জয়েন করেছি। বিনয় দক্ষিণ ভারতীয়, আমার বয়সী। আমার থেকে দু-তিন বছরের বড় দীনেশ এসেছে উত্তরাখন্ড থেকে, সদ্য বিবাহিত বউকে নিয়ে। এছাড়াও আছেন আমাদের প্রোজেক্ট ম্যানেজার সুরেশ মিশ্র। আমাদের প্রোজেক্ট অফিস থেকে দক্ষিণদিকে পনেরো মিনিট হেঁটে গেলেই আমাদের থাকার কোয়ার্টার, দশটা একতলা বাংলো টাইপের বাড়ি। কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে চারদিক ঘেরা। আমাদের বাড়িগুলোর ঠিক মাঝখানে ছিল অনেক রকম ফুলের ছোট্ট একটা বাগান। একটা বাড়িতে ছিল ক্যান্টিন।  সেখানে আমার মতো ব্যাচেলারদের খাবার ব্যবস্থা। সব মিলিয়ে শান্তির জীবন। অফিসার কলোনীর  ঠিক পরেই রয়েছে টিনের চালা দেওয়া ডরমেটরি টাইপের  ঘর। দূর থেকে দেখলে মনে হবে অনেকগুলো দেশলাই বাক্স  সারি করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। ওগুলো ছিল আমাদের শ্রমিকদের আস্তানা, সাময়িকভাবে সেগুলো বানানো হয়েছে।

 

আমাদের প্রোজেক্ট অফিসের ঠিক পেছন দিক দিয়ে শান্তভাবে পশ্চিমের জঙ্গলের বয়ে যাচ্ছে একটা ছোট্টনদী। মিনিট পাঁচেক ঐ নদী বরাবর উত্তর পশ্চিমে হেঁটে গেলে শাল-মহুয়ার গাছ ছাপিয়ে দেখা মিলবে মালভূমির পাহাড় ঘেরা ঘন জঙ্গলের। পায়ের তলার মাটি কখনো চড়াই ,কখনো বা উৎরাই। সেদিন আমাদের প্রোজেক্ট ম্যানেজার মিঃ মিশ্র দুপুরের খাবার খেতে তাঁর কোয়ার্টারে গেছেন। তিনি ফিরলে আমরা খেতে যাব। এটাই রোজের রুটিন। দেয়ালের সাথে লাগানো টেবিলের সামনে চারটে চেয়ার পাতা। একটা খালি। বাকি তিনটে আমরা তিনজন দখল করে যে যার কাজ করছি আর কথা বলছি। সন্ধ্যেবেলা আজ দীনেশের বাড়িতে চিকেন পকোড়া খাবার নেমতন্ন আছে। বাবা-মা , আত্মীয়স্বজন থেকে দূরে এই পান্ডববর্জিত জায়গায় চিকেন পকোড়ার মাহাত্ম্য কলকাতায় বসে বোঝা মুশকিল। কথা বলতে বলতে দীনেশ উঠে দাঁড়াল। তার আবার ফুসফুসে দম দেবার দরকার হয়েছে। বলল,” থোড়া সুত্তা মারকে আতে  হ্যায়….”, হাতের ইশারা করে বেরিয়ে গেল দীনেশ। আমি তখন টেবিলের ওপর ঝুঁকে প্রোজেক্টের ড্রয়িং দেখছি আর কথা শুনছি। কানের পাশে হঠাৎ একটা ঠান্ডা স্পর্শ অনুভব করলাম। ড্রয়ইং থেকে মুখ না তুলেই বিরক্তি প্রকাশ করলাম- ”উফ! ডিস্টার্ব মাত্ কর বিনয়!” বিনয় খুব মজা করতো, পেছনে লাগতো। ঠান্ডা জিনিসটাকে বিনয়ের স্বভাবগত পরিহাস ভেবে সরিয়ে দিলাম। আবার শীতল ছোঁয়া। ঠিক একই জায়গায়। এবার বিরক্ত হয়ে পেছন ফিরলাম। ”উফ্ ! বিনয়….।” চকিতে পেছনে ঘুরতেই আমার মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। বিনয় নয়, রাইফেলের নলের ঠান্ডা ছোঁয়া আমার কানের পাশে। রাইফেলটি হাতে নিয়ে আমার দিকে তাক করে দাঁড়িয়ে আছে এক মহিলা। পাঁচফুট মতো লম্বা,মুখটা পুরো গামছা দিয়ে বাঁধা, মাথায় টুপি,পরনে মিলিটারি ছাপ মারা পোষাক। বিনয়ের অবস্থাও আমার মতো। মহিলা চিৎকার করে বলল, ”হাত উঠাইয়ে” । আমি আর কথা বাড়ালাম না। বিনয়ের অবস্থাও আমার মতো। মহিলার কথা মতো দুটো হাত ওপরে তুলে বাইরে এলাম। বিনয়ের পেছনে আর একজন লোক একই ধরনের পোশাক পরে রাইফেল নিয়ে দাঁড়ানো। মহিলার নির্দেশে ঐ লোকটা বিনয়কেও বাইরে নিয়ে এল।
দুহাত তুলে দরজার চৌকাঠ পেরিয়ে সামনের ফাঁকা উঠোনটায় এলাম। দীনেশ ভাইয়ার অবস্থাও আমাদের মতো। গেটে দারোয়ানের হাত পিছমোড়া করে বাঁধা। দলের ওরা জনা আষ্টেক।

 

দারোয়ানটাকে দু-তিনবার চড়চাপড় মারল একজন। জানতে চাইল প্রোজেক্ট ম্যানেজার কোথায় গেছেন। দারোয়ান কাঁদতে কাঁদতে চেঁচিয়ে উঠল ,”মুঝে নেহি পাতা,মুঝে ছোড় দো,ম্যায় তো ইসি গাঁও কা হুঁ।’ আবার একটা লাথি মারল লোকটা। দারোয়ানজী টাল সামলাতে না পেরে হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেল। আমি আর চুপ থাকতে না পেরে চেঁচিয়ে উঠলাম, ”ইনকো মাত্ মারিয়ে।”
বলেই বুঝতে পারলাম  ভুল করেছি। চারদিকে কোনো শব্দ নেই। তার মানে আশে পাশে এদের আরো লোক  আছে । লোকটা রাইফেল টা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাক্ করল।
”ঠিক হ্যায়,তব তুম বাতাও,কাহা হ্যায় প্রোজেক্ট ম্যানেজার ?” আমার পিঠে একটা রাইফেলের নল, সামনে আর একটা। দুটো হাত ওপরে তোলা।
বললাম,”ম্যায়নে দেখা নেহি দোপহর সেহি”। একটা লাথি আশা করেছিলাম। কিন্তু আমাদের পকেট হাতড়িয়ে ওয়ালেট,মোবাইল নিয়ে নিল ওরা। হাত থেকে ঘড়িও খুলে নিল। তারপর সামনের লোকটা নির্দেশ দিল,” সব লোগ্ লাইন সে চালিয়ে”।
আমি, বিনয়, দীনেশ ভাইয়া, দারোয়ানজী, একজন অফিস বেয়ারা আর দুজন করনিক – সব মিলিয়ে সাতজন কে নিয়ে গেটের বাইরে এলো জঙ্গী দলটা। হ্যাঁ!জঙ্গী দল। ওদের পোষাক, হাতিয়ার আর ব্যবহারে বোঝা যাচ্ছে ওরা অতিবামপন্থী জঙ্গী। গেটের বাইরে এসে আমদেরকে ওরা নিয়ে চলল ছোট্ট নদীটার দিকে। পেছনে পড়ে রইলো আমাদের কোয়ার্টার। অস্বাভাবিক কোন ঘটনার আভাস বোধহয় ওখানে গিয়ে পৌঁছেছিল। কয়েকটা জালনা খুলে গিয়েছিল অকুস্থলে না এসেও যদি কিছু জানা যায়, সেই আশায়। চোখের ইশারায় নির্দেশ গেল দলনেতার।

 

একজনের কোচর থেকে বিদুৎ গতিতে হাতে উঠে এল বোমা। চোখের পলকে দু-তিনটে বোমের শব্দে কেঁপে উঠল মাটি। উড়ে যাওয়া ধুলোয় অস্পষ্ট হয়ে গেল আমার দৃষ্টি। বেশ কিছুক্ষণ পরে দেখলাম জালনাগুলো সব বন্ধ হয়ে গেছে। চারদিকে শশ্মানের নিস্তব্ধতা। নদীর জল হাঁটুর নীচে।বেয়নেটের সামনে প্রাণ হাতে করে নদী পেরোলাম। দুপাশের চেহারা ক্রমাগত বদল হতে শুরু করেছে ততক্ষণে। গাছগাছালির ঘনত্ব ক্রমাগত বাড়তে শুরু করেছে। সূর্যও ঢলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে। বাসায় ফেরা পাখিদের কিচিরমিচির সারা জঙ্গল জুড়ে। একটু পরে তাও থেমে গেল। কখনো সখনো ছুটিছাটার দিনে দু-তিন জন মিলে এদিকে এসেছি ঠিকই। কিন্তু জঙ্গলের এত গভীরে আসার সাহস কখনো হয়নি। অবশ্য স্থানীয় লোকজন ,আমাদের কুলিরা প্রায়ই জ্বালানি কাঠ কুড়োতে বা ফলপাকুড়ের খোঁজে এদিকে আসে। তবে গভীর জঙ্গলে আসে বলে মনে হয়না। বন্য জীবজন্তুর হাতে প্রাণ খোয়াতে সবাই নারাজ । অন্ধকারে জঙ্গল ভেঙে হেঁটে চললাম।  মাঝে মাঝে হোঁচট খাচ্ছি এবড়ো খেবড়ো জমিতে উঁচু হয়ে থাকা গাছের ডালপালা শিকড়বাকড়ে । ইতি উতি ঝোপঝাড়ে টান লেগে আটকে যাচ্ছে জামা কাপড়। কাঁটা ঝোপে হাত-পা কেটে  যাচ্ছে। নাক মুখ রুক্ষ মালভূমির লাল ধুলোয় ঢেকে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছি জানিনা। কতক্ষণ যাব তাও জানি না। শুধু জানি হাঁটা থামালেই তপ্ত বুলেটে এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যাবে আমাদের শরীর।

রাতের আকাশ থেকে অজস্র তারা আমাদের দিকে চুপ করে তাকিয়ে আছে। সম্ভবতঃ কৃষ্ণপক্ষ। তারাদের মাঝে ফ্যাকাশে একফালি চাঁদ আমাদের কোনো আলোর দিশা দেখাতে পারছে না। ঘন জঙ্গলের মাঝ দিয়ে সরু পায়ে চলা পথ , মানে এ তল্লাটে মানুষের পায়ের চিহ্ন নিয়মিতই পড়ে। আমি আর দীনেশ ভাইয়া পাশাপাশি হাঁটছি। আমাদের আগে বিনয়, দারোয়ান আর বাকী তিনজন। আমাদের পেছনে দুজন রাইফেলধারী। জঙ্গলে ঢোকামাত্র বাকীরা অন্ধকারে ভোজবাজির মতো উবে গেল যেন। কেবল বুঝতে পারছিলাম আমাদের দুপাশের উঁচু গাছের ডালপালা আর পাতাগুলো কেমন যেন বেমানান তালে নড়ছে। মুখবন্ধ করে চুপচাপ হেঁটে চলেছি। দুপুরে কিছু পেটে পড়েনি। এ হেন পরিস্থিতিতে পেটে কিছু পড়বার আশাও নেই। খিদেটা চাগার দিয়ে উঠে পেটের ভেতর লাফালাফি করছে।আর চুপ থাকতে পারলাম না।
দীনেশ ভাইয়াকে বলেই বসলাম, ”ভাবি কি  হাত কা বানা হুয়া পকোড়া নসিব মে নেহি হ্যায় সায়দ।”
দীনেশ ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে না হেসে পারল না। বলল,”ইস স্থিতি ভি তুমহে পকোড়া কি পড়ি  হ্যায়?”
-”যো হোনা হ্যায় ও তো হোগা হি ,সোচ কে কেয়া ফায়দা? চলো আগর জিন্দা রহা ফির কভি…”
বাঁচব কি? কি করতে চাইছে এরা আমাদের নিয়ে? মেরে ফেলবে? কি লাভ মেরে? সরকারকে ভয় দেখানো? নাকি আটকে রেখে কোম্পানীর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ দাবী করবে? কোম্পানী দেবে তো সেই টাকা? না পেলে বেয়নেটের মুখে আমরা সবাই একে একে….। কোম্পানীতে নিশ্চয়ই এতক্ষণে সবাই জেনে গিয়েছে যে আমরা অপহৃত। কি করছে কোম্পানী? সুদূর মুম্বাই থেকে ওরা কি করে যোগাযোগ করবে এই জঙ্গীদের সাথে? না কি এই লোকগুলোই কোম্পানীর সাথে যোগাযোগ করবে? আমাদের মোবাইলগুলোও তো ওরা নিয়ে নিয়েছে। কোম্পানী তো আমাদের সাথেও যোগাযোগ করতে পারবে না। নানারকমের চিন্তা মাথায় পাক খাচ্ছে। আর ভাবছি কিভাবে উদ্ধার পাবো এদের হাত থেকে। পালানোর কোনো উপায় নেই।

আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে, আড়াল থেকে আমাদের প্রতিটা পদক্ষেপে নজর রাখা হচ্ছে। কতক্ষণ হেঁটেছি জানিনা। সাত পাঁচ রকম ভাবতে ভাবতে হাঁটছি মেশিনের মতো। ঘন জঙ্গল। নিশাচর পাখিদের ডাক, ডানার ঝটপটানি ছাড়া কোন অন্য কোন বন্য প্রাণীর অস্তিত্ব টের পেলাম না। কেবলমাত্র ঝিঁঝি পোকার শব্দ সারা জঙ্গল জুড়ে নিস্তব্ধতাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। সামনের বাঁকটা ঘুরতেই একটা ফাঁকা জায়গায় এসে পড়লাম। ফাঁকা জায়গা মানে জঙ্গলের কিছুটা জায়গা পরিষ্কার করে নিয়ে দু-তিনটে শক্তপোক্ত চালাঘর তৈরী হয়েছে একেবারে গা ঘেষাঘেষি করে আর তার সামনে একটা উঠোন। উঠোনটায় জনা তিরিশেক লোক একসাথে জড়ো হতে পারবে। আমাদের সঙ্গে করে যারা নিয়ে এসেছিল তাদের আর দেখতে পেলাম না। রাতের অন্ধকারে চোখ সয়ে গেছিল এতক্ষণে। আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালো চারজন রাইফেলধারী। লম্বায় এরা ছ’ফুটের থেকে দু-তিন ইঞ্চি কম। আলো না থাকায় পোষাকের রঙ ঠিক ঠাহর না করলেও বুঝলাম পুলিশি বা মিলিটারী উর্দি ধরনেরই পোশাক পরেছে তারা। একজন জিজ্ঞেস করল আমাদের,”ভূখ লাগা ? কুছ খায়েগা?” আপ্যায়নের বহরটা তো বেশ ভালোই। বললাম,”পানি হ্যায়?”
লোকটা ডান হাতের তর্জনী তুলে ফাঁকা জায়গার একটা কোনে ,একটা ঝোপের দিকে দেখিয়ে বলল,”উধার যাও।”
নির্দেশ মতো এগোতেই ঝোপের আড়ালে চলে এলাম। উঠোনটা থেকে এই জায়গাটা দেখা যায় না। কতগুলো ইট সাজিয়ে তারওপর একটা মাটির কুঁজো রাখা। ওপরে একটা গ্লাস উল্টিয়ে রাখা আছে । গ্লাসটাকে হাতে নিয়ে কুঁজোটাকে কাত করে জল ঢালতে যাব, সে সময়ে পাশে নজর পড়ল আমার। আরে! এ তো সেই মেয়েটা! যে আমাকে বন্দুক দেখিয়ে অফিস থেকে তুলে নিয়ে এল! দু-পা উঁচু করে ছড়িয়ে কনুই দুটো দু-হাঁটুর ওপর রাখা। ভাঁজ করা হাত দুটো বুকের সামনে নিয়ে কপালটা ঈষৎ ঠেকিয়ে রেখেছে সে। আমার শব্দ পেয়ে চোখ তুলে তাকাল। দেখে মনে হল ধুকছে , ক্লান্ত।
আমি জিজ্ঞেস করলাম,”পানি?”
সে ঘাড় নেড়ে ”হ্যাঁ” বলল।
আমি কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে ওর হাতে দিলাম। আলতো করে মুখের ওপরে ধরে জল খেল ও। ফেরত দিল গ্লাসটা। আমি আবার কুঁজো থেকে জল ঢাললাম। জল খেলাম। গ্লাসটা আগের মতো করে কুঁজোর ওপর রাখলাম। একবার তাকালাম মেয়েটার দিকে। মাথা নীচু করে আগের মতোই ও বসে । ফিরে গেলাম ঐ ফাঁকা জায়গায়।

আমাদের সবাইকে একলাইনে বসনো হয়েছে মাটির উঠোনের । একজন একজন করে ডেকে দ্বিতীয় দফার তল্লাশি চলছে তখন। জানতে চাওয়া হচ্ছে আমাদের ডেসিগনেশন্। আমি লাইনের শেষ প্রান্তে গিয়ে বসলাম। কিছুপরে আমার ডাক পড়ল। হুকুম তামিল না করে উপায় নেই। আমাকে দলনেতাটি জিজ্ঞেস করলো,”তুম বাঙালি?”
আমি বললাম,”হা।”
– কাহা রহতে হো?
-কলকাত্তা
–কেয়া করতে হো?
-ইঞ্জিনিয়ার
-কাহা সে পড়হাই কিয়া?
–যাদবপুর।
কিছুটা সময় নিল লোকটা। কি যেন ভাবল।তারপর ডেকে নিল নিজের পাশে। আমিও লোকটাকে ভালোভাবে দেখার সুযোগ পেলাম। চাপা নাক,ছোট চোখ,গায়ের রঙে মঙ্গোলিয়ান ছাপ সুস্পষ্ট। অন্যদের থেকে সহজেই আলাদা করা যায় লোকটাকে। মনে হল দেশের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর কোন একটায় এই দলনেতার শিকড়। আমাকে বলল,”আমরা কি চাই তুমি জানো?”
-জানি। ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার উচ্ছেদ।
– আমরা নকশাল। তুমি জান তো নকশালদের ?
আমি খুব স্বাভাবিকভাবে বললাম ,”যাদবপুরের ছাত্র তো? নকশাল আন্দোলন আমি অনেক কাছ থেকে দেখেছি। বামপন্থী রাজনীতি ছাত্র অবস্থায় আমিও করেছি।”
– তুমিও নকশাল ?
-নাআ। আমি বললাম, তোমাদের মত আমি সমর্থন করি , কিন্তু পথ নয়। বেয়নেট দিয়ে কখনো সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন সম্ভব হয় না।

সাধারণ মানুষকে সচেতন করে জনসমর্থনের মধ্যে দিয়েই সমাজের কাঠামো বদল সম্ভব।”

বন্দুকের নলের সামনে দাঁড়িয়ে শান্ত অথচ দৃঢ়ভাবে কথাগুলো বললাম। আগামী মুহূর্ত আমার জন্য কি নিয়ে অপেক্ষা করছে সেটা না ভেবেই নিজের ভাবনাগুলো যেন হঠাৎই  মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল স্বতঃস্ফূর্তভাবেই। পরক্ষণেই মনে হল এবার একটা বুলেট ছুটে এসে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেবে আমার হৃৎপিন্ডটা। কিন্তু দলনেতাটি চোয়াল শক্ত করে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। বুঝলাম, ও এই সামান্য কথায় বুলেট খরচ করতে  চাইছে না। আমিও বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলাম।

-তোমাদের প্রোজেক্ট ম্যানেজারকে খুঁজছি। আমি বললাম, তাঁর খবর কিভাবে দেব? সব ফোন তো তোমাদের কাছে।

দলনেতার নির্দেশে আমার ফোন আমার কাছে দিয়ে গেল একজন। ভাবলাম,”যাক ফোনটা তো হাতে পাওয়া গেল। এবার সুযোগের অপেক্ষা…!” আমি হেড্ অফিস মুম্বাইতে ডায়াল করলাম। ওপ্রান্তে অপারেটর বলল,”হ্যালো।” আমি আমার  ” হিউম্যান রিসোর্স ”এর প্রধানকে দিতে বললাম। ফোনে জানালাম তাঁকে আমাদের অপহরণের কথা। সব শুনে তিনি ওদের সাথে কথা বলতে চাইলেন। হাত বাড়িয়ে ফোনটা এগিয়ে দিলাম। ফোনটা সঙ্গে সঙ্গে আমার হাত থেকে নিয়ে নিল দলনেতা। মিলিয়ে গেল জঙ্গলের ভেতরে।

পেছনে যে দুটো ঘর ছিল তার একটার দরজা খুলে আমাদের ঢুকিয়ে দেওয়া  হল। ইতিমধ্যে দলনেতাটি ফিরে এসেছে।  সে ঘরে ঢুকে হিন্দী তে যা বলল তার সারমর্ম হল এরকম।
– দেখো , তোমাদের সাথে আমাদের কোনো ব্যক্তিগত শত্রুতা নেই। তোমরা একটা পুঁজিবাদী সংস্থার হয়ে কাজ করছো। আমাদের লড়াই তোমাদের মালিকদের সাথে। তোমাদের কোম্পানী আমাদের কথা শোনেনি , আমরা তাই বাধ্য হয়েই তোমাদেরকে নিয়ে এসেছি, তোমাদের ম্যানেজমেন্টকে মেসেজ দেবার জন্য। আমাদের প্রাপ্য  টাকা পেলেই তোমাদের ছেড়ে দেব। এজন্য সবাইকে এখানে আটকে রাখব না। আমরা এই তিনজন ইঞ্জিনিয়ার সাহেব কে আমাদের অতিথি করে রাখতে চাই। বাকিদের আমাদের লোক গিয়ে গ্রামে পৌঁছে দিয়ে আসবে। আমি , দীনেশ ভাইয়া আর বিনয় অন্ধকার ঘরের মেঝের ওপর বসে পড়লাম। বাকি চারজনকে বের করে নিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিল ওরা। আমাদের বাইরের জগতের সাথে যোগাযোগ বলতে একটা খোলা জালনা । সেখান দিয়ে শুধুমাত্র অন্ধকার আকাশ দেখা যাচ্ছে। জানিনা, আর কখনো কোনোদিনও তারাভরা আকাশের নীচে দাঁড়াতে পারব কিনা?

গুলির শব্দে ঘুম ভাঙলো। অন্ধকারে চোখ খোলার একটু সময় নিল মস্তিষ্ক। মনে পড়ল আজকের সারাদিনের ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো। ক্লান্ত শরীর , মানসিক টানাপোড়েন , পেটের খিদে কখন মিলেমিশে এক হয়ে চোখ বুজিয়ে দিয়েছিল বুঝতে পারিনি। অবিরাম গুলিবৃষ্টির শব্দে হুঁশ ফিরল। দীনেশ ভাইয়া আর বিনয় দুজনের অবস্থাও আমার মতোই। ঘরের মেঝের ওপর ওরাও ঘুমিয়ে পড়ছিল। গুলির শব্দে এখন জেগে উঠেছে। একটু পরে বুঝলাম গুলি নয়, বোমা ছোঁড়াছুঁড়িও চলছে। আমাদের খবর কি তাহলে প্রশাসনের কাছে পৌঁছে গেছে? উদ্ধার করতে পুলিশ এসেছে ? মুক্তির আশায় মন দুলে উঠল। কানফাটা শব্দ। তার সাথে পাশের দেওয়ালটা হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল। পাশের ঘরে আগুনের শিখা লকলকিয়ে উঠছে। শেষে কিনা পুড়ে মরতে হবে নাকি বন্দীদশায়! মনকে আর শান্ত রাখতে পারলাম না। তিনজনে ছুটে গেলাম দরজার কাছে। দরজা ধাক্কাতে লাগলাম। যদি দরজাটা ভেঙে ফেলতে পারি তাহলে অনন্ত পুড়ে মরতে হবে না । কিন্তু এই গুলি যুদ্ধের শব্দে আমাদের আর্তনাদ, দরজায় ধাক্কা দেবার শব্দ সব চাপা পড়ে গেল। সামনে থেকে দেখতে লাগলাম মৃত্যুর এগিয়ে আসা। বাড়ির একপাশে দাউদাউ করে জ্বলছে আর আমরা অপেক্ষা করছি তার আগ্রাসনের শিকার হবার। ঝনাৎ করে শব্দ হল। আমাদের ঘরের দরজা খুলে ঘরে ঢুকলো সেই মেয়েটা। আমাদের ঘরের পেছন দিকের দেওয়ালে একটা ছোটো দরজা ছিল। খুব তাড়াতাড়ি চাবি ঘুরিয়ে সেটা খুলে ফেলল ও। বলল,”মেরি পিছে আও।”


মাথা নীচু করে মেয়েটা গলে বের হল। ও নেমে যেতেই আমি মাথা গলা বের করলাম ছোটো দরজাটা দিয়ে। আগুনের আলোয় চারিদিক স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মেয়েটা একটু নীচে দাঁড়িয়ে আছে। ভাল করে দেখলাম আবার। নীচে জঙ্গলভরা খাদ। আর ওপরে আকাশ। এখানে নেমে কোথায় যাব আমরা? ভেবে চিন্তে কাজ করবার সময় এখন নয় । শরীরটাকে দুমড়িয়ে ভাঁজ করে লাফিয়ে নীচে নামলাম ।
আমার দেখাদেখি দীনেশ ভাইয়া আর বিনয় লাফিয়ে নামল। মেয়েটা পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। খাদ বেয়ে ক্ষিপ্র শ্বাপদের মতো তরতরিয়ে নিচে নামছে মেয়েটি। জঙ্গলের গাছগাছালির মধ্যেও রাস্তা চিনতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না ওর। পেছনে গুলি আর বোমার শব্দ ক্রমাগত ফিকে হয়ে আসছে। আমরা যে ঘরটায় ছিলাম সেটা এখন পুরোটাই দাউদাউ করে জ্বলছে। ধোঁয়াগুলো পাক খেয়ে রাতের আকাশে ছড়িয়ে পড়তে পড়তে মানবসভ্যতার লোলুপ রসনার বিস্তৃতি জানান দিচ্ছে। কোথায় যাচ্ছি জানিনা। কত রাত তাও বুঝতে পারছি না। মেয়েটিকে অনুসরণ করতে হবে এইটুকুই জানি। জঙ্গলের জীবজন্তু পশুপাখি গোলাগুলির শব্দে নিঃশব্দে রয়েছে। সভ্য মানুষ বরাবরই তাদের অশান্তির কারণ। ঘন্টা দেড়েক হেঁটেছি মনে হয়। একফালি চাঁদের আলোয় অদূরে দেখা যাচ্ছে নীলচে-কালো রঙা কয়েকটা বাড়ি। একটা ছোটো গ্রাম। আমরা মেয়েটার পেছন পেছন গ্রামে এসে পৌঁছলাম। মাঝখানে গোল ফাঁকা জায়গা আর সেই জায়গা ঘিরেই দশ-বারোটা ঘর। ঘর মানে খোলার ছাদ আর মাটির দেওয়াল। এরকমই একটা ঘরের সামনে এসে দরজার কড়া নাড়ল মেয়েটা। -”কৌন?”এক বয়স্ক মহিলার কন্ঠস্বর। হিসহিসে গলায় বলল মেয়েটি, “ম্যায় হু , জানকী?”
মেয়েটার নাম তাহলে  জানকী ।
এক বৃদ্ধা বেরিয়ে এলেন দরজা খুলে। অসংখ্য বলিরেখা মুখের ওপর আলপনা এঁকেছে অবাধেই। ঘোমটার টান সামনের দিকের সাদা চুলটাকে পুরোপুরি ঢাকতে পারেনি।
আমাদের দিকে মুখ ফেরালো জানকী।
জিজ্ঞেস করল, ”কুছ খায়োগে?” আমি জল খেতে চাইলাম। আমাদের ঘরের সামনে দাঁড় করিয়ে রেখে সে ঢুকে গেল। খোলা উঠোনের এক ধারে বড়ো কুয়ো, গ্রামের লোকেদের জলের ভরসা। কুয়োর উল্টোদিকের কোনে একটা ছোটো চালাঘরে একটা সিঁদুর লেপা লালরঙের গদাধারী হনুমানের মূর্তির সামনে টিমটিম করে প্রদীপ জ্বলছে। এই দুই এর মাঝখানে মাটি দিয়ে উঁচু করা একটা বেদী , একসাথে বসার জায়গা। আমরা তিনজন সেখানে গিয়েই বসলাম। নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলার ইচ্ছে আর নেই। ভাগ্য আমাদের তিনজনকে একই সুতোয় গেঁথেছে। একটু পরে একটা ঘটি আর গ্লাস হাতে নিয়ে সালোয়ার কামিজ পরা একটা মেয়ে এসে দাঁড়ালো।

-”লিজিয়ে,পানি।” পুলিশি উর্দি পরা যে জানকীকে আমি জল দিয়েছিলাম, এই গ্রাম্য বধূঁ কি তাঁর প্রতিদান দিল?

চোখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম। আরে এ তো জানকী! গামছা বাঁধা নাকমুখ আর পুলিশী পোশাক খুলে এক দেহাতী রমণী ঘটি থেকে জল গড়িয়ে আমার হাতে দিল। গায়ের কালো রঙ, উঁচু দাঁত, কোঁকড়ানো কটা চুলের মধ্যে কোনো ক্ষিপ্রতার হিংস্রতার চিহ্নমাত্র নেই। আবার মালভূমির লালমাটি ওর ঘামে ভেজা শরীরে নারীর লালিত্যকেও প্রশ্রয় দেয়নি। জল খেলাম।
বলল,” মন্দির কে পিছে সে সিদ্ধা চলা যাও,কুছ দূর জানে সেহি হাইওয়ে মিলেগা।”
-”থোড়া রাস্তা দিখায়গি?”অনুরোধ করলাম।
দেহাতী হিন্দিতে ও যা বলল তা হল ,
”আমার শরীরটা ভালো নেই বাবু। নাহলে যেতাম। গ্রামে বেটাছেলেরা কেউ নেই। তাই কারুকে সঙ্গেও দিতে পারছি না। আপনারা যান। সোজা রাস্তা। কোনো অসুবিধা হবে না।”
ছোটো গ্রামটাকে পেছনে ফেলে আমরা জানকীর দেখানো পথে চলতে শুরু করলাম ।
হাঁটুজল ঠেলে নদীর ওপারে যখন পৌঁছলাম তখন পূবের আকাশে রঙের আভা। নদীর পাড় ধরেই হাঁটছি আমরা। এখানে জঙ্গল খুব একটা ঘন নয়। পাখির দল কিচিরমিচির করে উড়ে যাচ্ছে শহরের দিকে। আমাদের দেখে ইতিউতি পালিয়ে যাচ্ছে কাঠবেড়লীরা। দ্রুত পায়ে সরে যাচ্ছে সজারু। বনমোরগ এঁকে বেঁকে ছুটে লুকিয়ে পড়ছে ঝোপের আড়ালে। গাছের ডালে বসে লেজ ঝুলিয়ে আমাদের দিকে চোখ কুঁচকিয়ে তাকিয়ে আছে কয়েকটা হনুমান। কাঠঠোকরার ঠকঠকানির সাথে ঝিঁঝি পোকাদের ফিউশান সারা জঙ্গল জুড়ে। নদীর জলে পানকৌড়ি গলা উঁচু করে ভেসে বেড়াচ্ছে আর ডুব দিচ্ছে। জলে দলবেঁধে সাঁতরে বেড়াচ্ছে কয়েকটা বুনোহাঁস। নদীর ওপারে এপারে শিকারী মাছরাঙারা চুপ করে বসে আছে। নদীর জলে ভেসে চলা গাছের ভাঙা ডালের ওপর একমনে কোঁচবক তপস্যা করে চলেছে মাছের আশায়। একটু একটু করে ভোর হল চোখের সামনে। মুক্তির ভোর ! অবসন্ন শরীরটাকে কোনোক্রমে টেনে নিয়ে চলেছি আমরা। গত চব্বিশ ঘন্টায় পেটে পড়েনি কিছু। ঘুমও নেই। বুঝতে পারছি জঙ্গিদলটা নিজেদের রক্ষা করতেই ব্যস্ত এখন। আমাদের দিকে নজর দেবার সময় এই মুহূর্তে ওদের নেই। তাই যাবতীয় ক্লান্তি সরিয়ে রেখে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখানে থেকে বের হয়ে হাইওয়েতে পৌঁছতেই হবে আমাদের। গাছগাছালি ক্রমাগত পাতলা হয়ে আসছে। জঙ্গলের ভেতরে নদীর পাড় থেকে এঁকেবেঁকে ঢুকে যাওয়া সরু পথ এখানে মানুষের আনাগোনার কথা জানিয়ে দিচ্ছে। আমরা ঐ পথটাই ধরলাম। ভুল যে করিনি সেটা কিছুপরেই বুঝলাম। একটা চালাঘর নজরে পড়ল। সেটা একটা দোকান। জঙ্গলের মধ্যে দোকান! সামনে এগিয়ে দেখি দোকানে বিস্কুট ,মুড়ি, ছাতু,নুন ,চিনি এসব ছাড়া আর কিছু মজুত নেই। কিন্তু কেনে কারা? আমাদের দেখে দোকানী নিজেই এগিয়ে এল।
-হাইওয়েটা কোন দিকে ভাই? জিজ্ঞাসা করলাম। দোকানী তর্জনী তুলে ডানদিকটা দেখিয়ে দিলো। জানতে চাইলো আমরা কোথা থেকে এসেছি। খাবার জল দিলো।
বললাম, ”কাল দুপুরে জঙ্গলে বেড়াতে এসে পথ হারিয়েছিলাম। ঘুরতে ঘুরতে এক গ্রামে গিয়ে পৌঁছই। সেখানেই রাত কাটিয়েছি। এখন ফিরছি। হাইওয়েটা কোনদিকে বলে  দিলে ভালো হত …।”
লোকটা আমার কথা শুনে হাসল। বলল ,”দাঁড়ান। আমার একটা ট্র্যাক্টর আছে। সেটায় করে আপনাদের হাইওয়ে অবধি এগিয়ে দিয়ে আসি।”
– আমরা একটা ফোন করতে পারি?
-করুন।
– না…মানে আমার মোবাইলটা হারিয়ে ফেলেছি। আর ওদের ফোনে চার্জ শেষ। আপনার ফোনটা একটু যদি দেন… কথা না বাড়িয়ে ফোনটা এগিয়ে দিল লোকটা। কোডারমার অফিসে ফোন করলাম।
-হ্যালো ,হ্যালো, চৌধুরী বলছি কোসমা থেকে।
-এই ,চুপ চুপ। মিঃ চৌধুরীর ফোন। হ্যাঁ-হ্যাঁ, বলুন। কোথায় আছেন আপনারা এখন? কেমন আছেন?
-আমরা আর একঘন্টার মধ্যেই হাইওয়েতে গিয়ে পৌঁছচ্ছি। জায়গাটা হাজারিবাগ জঙ্গলের মধ্যে আর বাহিরের থেকে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার ভেতরে। আপনারা  অফিসের একটা গাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করুন। আমাদের তিনজনকে নিয়ে যাতে কোসমা পৌঁছে দেয়।
-ও.কে মিঃ চৌধুরী। আপনারা আসুন। আমরা গাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।
এরপর আধঘন্টা বসিয়ে রেখে লোকটা ট্র্যাক্টর নিয়ে এল। ট্র্যাক্টর করে প্রায় একঘন্টা সময় নিল হাইওয়েতে পৌঁছতে। আমাদের নামিয়ে দিয়ে লোকটা বলল, ”আপনারা গ্রাম ছেড়ে চলে আসার পর ভোরবেলা জানকী ধরা পড়েছে।” আর অপেক্ষা করল না সে। চোখের পলকে ট্র্যক্টর ঘুরিয়ে ধুলো উড়িয়ে  জঙ্গলের ভেতরে  ঢুকে মিলিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে ট্র্যাক্টরের শব্দও আর কানে এল না। আরো ঘন্টা খানেক অপেক্ষা করে অফিসের গাড়ি যখন আমাদের হাইওয়ে থেকে উদ্ধার করলো তখন বেলা একটা।
আমাদের গাড়ি ঢুকলো অফিসার্স কলোনীর মধ্যে। কলোনীর বাসিন্দারা ছাড়াও আরো অনেকে ভিড় জমিয়েছে আমাদের দেখবার জন্য। ”অনেকে” বলতে প্রোজেক্টের কুলি-কামিন-মজুররা আর তাদের পরিবারের লোকজন। দেখলাম না কেবলমাত্র প্রোজেক্ট ম্যানেজার মিঃ মিশ্রকে। গাড়ি থেকে নেমে যে যার বাড়িতে ঢুকলাম। কলোনীর কেয়ারটেকারের কাছে ডুপ্লিকেট চাবি ছিল । সেটা দিয়ে ঘরের দরজার তালা খুললাম। অফিসে তল্লাশির সময় চাবিটাও ওরা নিয়ে নিয়েছিল। স্নান করে খেয়ে সন্ধ্যেবেলায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সেই ঘুম ভাঙল পরদিন সকালে কলিং বেলের শব্দে। ঘড়ির কাঁটা আটের ঘরে পৌঁছতে আর মিনিট দশেক। দরজা খুলে দেখি প্রোজেক্ট ম্যানেজার মিঃ মিশ্র।
-আপলোগ ক্যায়সে হো?
– “আচ্ছা । উসদিন আপ কাহা থা?  আমি কৌতূহল চাপতে না পেরে জিজ্ঞেস  করে বসলাম।
মিশ্রজী শুদ্ধ ভোজপুরী উচ্চারণে  বলতে শুরু করলেন,”পরশুদিন যখন লাঞ্চ করতে বাড়ি আসছি তখনই দেখি দু-তিন জন লোক নদী পেরিয়ে অফিসের দিকে আসছে। ভাবলাম মজুরদেরই কেউ হবে অথবা আশপাশের গ্রামের লোক। অতটা বুঝতে পারিনি। বাড়িতে এসে খেলাম। তারপর বের হতে যাব তখন বোমার শব্দ পেয়ে চমকে উঠলাম। সঙ্গে সঙ্গে জালনা খুললাম। কিন্তু এত ধুলো জালনা বন্ধ করে দিলাম। কি হচ্ছে কিচ্ছু বুঝতে পারছিলাম না। তোমাকে ফোন করি। ফোন সুইচড্ অফ্। দীনেশ আর বিনয়কেও ফোন করি। ওদেরও ফোন বন্ধ পাই। একে একে অফিসের সবাইকে ফোন করি। সবার ফোনই বন্ধ। কি করব বুঝতে পারছিলাম না। হেড অফিসে ফোন করি। হেড অফিস বাড়ি থেকে বের হতে নিষেধ করে। পরশু সারাদিন আর বের হই নি। তোমাদের সবাইকে বারবার ফোন করে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে গেছি। সবার ফোন বন্ধ। অফিসেও যে লোক পাঠিয়ে যোগাযোগ করব তাও উপায় ছিল না। অফিসের ফোনও বেজে যাচ্ছিল। সন্ধ্যেবেলাতেও তোমরা কলোনীতে ফিরলে না। আমার উদ্বেগ বাড়ছিল।  প্রায় সন্ধ্যে সাতটা। এস টি এফ এসে উপস্থিত।সঙ্গে বিশাল পুলিশ বাহিনী। বুঝলাম খবরটা প্রশাসনের কাছে পৌঁছে গেছে। ওদের সাথে দফায় দফায় মিটিং চলতে থাকে। এর মধ্যে আবার সাংবাদিকরা হাজির, তাদের  প্রশ্ন বাণে জেরবার হবার জোগাড়। হেড অফিসে আর কোডারমাতে  ঘনঘন ফোন করতে থাকি। রাত বারোটা নাগাদ হেড অফিস থেকে খবর পাই তোমরা কিডন্যাপড্। গতকাল ভোররাত্রে তোমরা তিনজন ছাড়া বাকি চারজন ফিরে আসে। ওদের কাছে থেকে পুরো ঘটনা শুনি। খবর পাই হেড অফিস ঐ দলটার সাথে যোগাযোগ রেখে চলছে। ”
আমি বললাম,”ওরা তো আপনাকে খুঁজছে।”
মিশ্র জীবন বললেন,” জানি। তাই তো গতকাল বাড়ি থেকে বের হতে নিষেধ করেছিল। তোমরা ফিরে এসেছো মানে হেড অফিসের সাথে নিশ্চয়ই কিছু রফা হয়েছে।”
– না, না , ব্যাপারটা ঠিক তাই নয়। ওরা আমাদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। মিঃ মিশ্রকে গতরাত্রের সমস্ত ঘটনা খুলে বললাম। আরো বললাম , ”ওদের মধ্যে কেউ কেউ ধরা পড়লেও আমাদের এখনও সাবধানেই থাকা উচিত। ঘটনা কখন কোনদিকে মোড় নেবে কে জানে? হেড অফিসের থেকে ফোন না এলে আমরা অফিসে যাব না। ততদিন কাজ বন্ধ থাকলে থাকবে।” আরো একটা দিন আমরা কলোনীতে যে যার বাড়িতেই রইলাম।

সেদিন বাড়িতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে  আগের দুদিনের ঘটনাগুলো টুকরো টুকরো বারবার মনে ভিড় করে আসছিল। বিশেষতঃ জানকীর মুখ  ঘুরেফিরে চোখের সামনে ভেসে উঠছিল । বন্দুকধারিনী জঙ্গীনেত্রী কেন যে আমাদের প্রাণ বাঁচালো জানিনা।  প্রতিটি মেয়ের  মনের কোনেই কমনীয়তা হয়তো  এভাবেই  লুকিয়ে থাকে।ও কি দলের নির্দেশেই পেছনের খাদ বেয়ে নামিয়ে আনল আমাদের ? কিন্তু ও কি জানতো না বাড়ি ফিরলে ও নির্ঘাত  ধরা পড়বে?
হেড অফিসের নির্দেশে তার পরদিন থেকে অফিসে যাওয়া শুরু করলাম। দু-তিন পরে অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে এল। কাজের মধ্যে ডুবে আমাদের উত্তেজনাও ধীরে ধীরে কমে আসতে লাগল।  যদিও রাতে একলা বিছানায় শুয়ে খাপছাড়া ভাবে ঘটনাগুলো আনাগোনা করে।জানকী কেন আমাদের পালানোর পথ দেখিয়ে দিল এই প্রশ্নের উত্তর আমি কিছুতেই খুঁজে পেলাম না।
দিন পনেরো পরে, দুপুর বেলা লাঞ্চ করব বলে ঘর থেকে বেরিয়ে অফিস চত্বরের ফাঁকা জায়গাটায় এসে দাঁড়িয়েছি। এ কি! আ-বা-র! এবার ঐ মোঙ্গলীয়ান দলনেতা , সাথে আরো দুজন। তাদেরকে দেখে বোঝা যাচ্ছে যে তারাও স্থানীয় লোক নয়। সম্ভবতঃ দক্ষিণ ভারতীয় । তবে আজ আর যুদ্ধের পোশাকে নয়,সবাই এসেছে সাদা পোশাকে। ওদের হাতে কোনো অস্ত্রও চোখে পড়ল না।
-প্রোজেক্ট ম্যানেজারের ঘর কোনটা? পরিচিত নেতাটি জিজ্ঞেস করল আমাকে।
আমি দেখিয়ে দিলাম। মনে মনে ভাবলাম , ”আবার যেতে হবে ওদের সাথে!”
না, এবার কপাল ভালো আমাদের! সেরকম কোনো পরিস্থিতি তৈরী হল না। সঙ্গের লোকদুটো প্রোজেক্ট ম্যানেজারের ঘরে ঢুকলো। মঙ্গোলীয়ান নেতা বাইরেই দাঁড়িয়ে রইল। আমাকে বলল,”লাঞ্চ করতে কি বাড়ি যাচ্ছো?”
আমি বললাম,”হ্যাঁ। ”
একটু সাহস করে জিজ্ঞেস করলাম ,”তুমি একা? জানকী কোথায়?”
-জানকী ধরা পড়েছে। এখন রাঁচির জেলে আছে।
-আমি যখন জল খেতে গেছিলাম তখন ওকে দেখে অসুস্থ লাগছিল।
– ও প্রেগন্যান্ট।
প্রেগন্যান্ট! এই অবস্থায় জেলে! একদিকে ভালো। জেলের হাসপাতালে ডাক্তার আছে। ওর দেখা শোনা করবে। জানতে চাইলাম , ”ওর বর? সেও কি ধরা পড়েছে?”
জঙ্গী নেতা একথার কোনো উত্তর দিল না। আমিও নিজেকে সামলে নিলাম। বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি হয়তো। তাড়াতাড়ি কলোনীর পথে পা বাড়ালাম। সময়ের গতিতে সব ঘটনাই যেমন ফিকে হয়ে যায় এই ঘটনাটাও তার ব্যতিক্রম হয়নি। প্রোজেক্টের কাজ শেষ করবার নির্ধারিত দিন আসতে আর ছ’মাস বাকী। দ্রুত গতিতে কাজ এগোতে লাগল। তার মধ্যেই দিনরাত ডুবে রইলাম। এর মধ্যেই একদিন রাঁচি কোর্ট থেকে ডাক পড়ল। আমরা তিনজন, আমি ,বিনয় আর দীনেশ ভাইয়া ,অফিসের গাড়ি চড়ে নির্দিষ্ট দিনে হাজিরা দিলাম নির্দিষ্ট জায়গায়।
কোর্ট চত্বরে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে হালকা কথাবার্তা চলছিল। দুটো প্রিজন ভ্যান এসে আমাদের সামনেই থামলো। বেশ কয়েকজন পুলিশ আর মহিলা পুলিশ নামলো সেখান থেকে। আর সঙ্গে করে নামালো আরো ছ’টি পরিচিত মুখকে। তার মধ্যে একজন হল জানকী। সাদা সালোয়ার কামিজ পরা কালো মেয়েটার হাতদুটো আজ দড়ির বাঁধনে আটকা। আমাদের দিকে একবার দেখলো সে। তারপর ধীর গতিতে এগিয়ে গেল আদালতের ঘরের ভেতরে। যথা সময়ে ডাক পড়লো আমাদের। একে একে সবাই একক ভাবে হাজিরা দিলাম। মাননীয় বিচারপতির নির্দেশে সেদিনের ঘটনার বিবরণ দিলাম খোলা আদালতে। উকিল সাহেবের যাবতীয় প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিয়ে বের হয়ে এলাম। বিচারাধীন বন্দী জানকী চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে ওর সব সাথীদের সঙ্গে। চোখে মুখ শান্ত ,আবেগহীন , নির্বাক।

মাস তিনেক পরে খবর পেলাম ওরা সবাই দোষী সাব্যস্ত হয়েছে । শাস্তি হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদন্ড। খুব শীগগীরই দিল্লীতে তিহার জেলে ওদের কে স্থানান্তরিত করা হবে। ইচ্ছে হল, একবার জানকী কে দেখে আসি। পরদিনই ছুটির ব্যবস্থা করে চলে এলাম রাঁচিতে। জেলার সাহেবের সাথে দেখা করে নিজের পরিচয় দিলাম। জানালাম নিজের ইচ্ছের কথা। আমার ইচ্ছের কথা শুনে একটু অবাকই হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু যে কোন কারনেই হোক রাজি হয়ে গেলেন।পরদিন বেলা বারোটা নাগাদ তাঁর সাথে দেখা করতে বলল। বেলা বারোটার আগেই হাজির হয়েছিলাম । জেলার সাহেব আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে দাঁড়ালেন জানকীর সেলের সামনে।

জেলার সাহেবের সাথে লম্বা করিডোর ধরে ফিরে আসত আসতে সব ঘটনাগুলো সেলুলয়েডের চলমান ছবির মতো চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল। বন্দুকধারিনী জঙ্গীনেত্রী জানকীর সাথে আজকের জানকী কে আমি কিছুতেই মেলাতে পারছিলাম না। আমি জেলারের সাহেবের সাথে ওনার চেম্বারে ঢুকলাম। জেলার সাহেব নিজের চেয়ারে বসবার আগে টেবিলের উল্টোদিকের চেয়ারটা দেখিয়ে আমাকে বললেন, ”বসুন মিঃ চৌধুরি।”
আমি বসলাম। জেলার সাহেব এরপর বেয়ারাকে ডেকে জল আনালেন । জল খেলাম। মনের উত্তজনা কিছুটা কমল। আমি বললাম, ”এবার চলি মিঃ আগরওয়াল। আমার ইচ্ছেপূরণ করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আপনার অনেকটা সময় নষ্ট করে দিয়ে গেলাম।”
জেলার সাহেব মিঃ আগরওয়াল বললেন,”বসুন মিঃ চৌধুরি।” ভাঙা বাংলায় বলতে শুরু করলেন মিঃ আগর ওয়াল, ”আপনি তো জানকী কে দেখার জন্যই  এতদূর ছুটে  এসেছেন । তাই তো? তাহলে শুনুন, ওর কথা আপনার এখনো কিছুই জানা হয়নি। শুনে যান জানকীর গল্প।” আমার কৌতূহলী চোখ আর আনমনা মন  মিঃ আগর ওয়ালের দৃষ্টি এড়িয়ে  যেতে  পারে নি।আমি জেলার সাহেবের অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারলাম না। আমি শুনতে লাগলাম জানকীর কথা।

জানকীর গ্রামের নাম হাসিল। মাত্র বারো বছর বয়সে ওর বিয়ে হয়। রোগা,কালো,দাঁত উঁচু মেয়েটার গরীব বাবা একটা ছাগল আর পাঁচ বস্তা গমের বিনিময়ে মেয়েটাকে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দেয়। বর ওর থেকে দশ বারো বছরের বড়ো। শ্বশুরবাড়িতে বেগার খাটত ও। সূর্য ওঠার আগে উঠোন নিকানো ,জল তোলা, ঘুঁটে দেওয়া ,বাসন মাজা , কাঠ চিরে স্নান করে নিয়ে ঢুকতো রান্না ঘরে। রান্না ঘরের কাজ সবই করতো কিশোরী জানকী। তারপর ছিল শাশুড়ির হুকুম তামিল করা,তার সেবা যত্ন করা। সারাদিনে এতটুকু জিরোবার ফুরসত পেতো না ও। রাতে সবাইকে খাইয়ে তলানি যেটুকু পড়ে থাকত তাই হতো ওর রাতের খোরাক। দেরী করে শুতে যাবার জন্য স্বামীর কাছে জুটত গালিগালাজ, চড়-লাথি। নেশাতুর হিংস্র শ্বাপদের মতো জানকীর শরীরটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত সে। স্বামীর শরীরের খিদে মিটিয়ে সদ্য কিশোরী জানকীর শ্রান্ত দেহটা খুব অল্পই সময় পেতো বিশ্রাম নেবার। মুখ বুজেই ছিল জানকী। কারণ বাপের ঘরে তো আর খাওয়া জুটবে না! গর্ভবতী হয়ে পড়ল সে। কিন্তু তাতেও তার পরিশ্রমের কমতি হল না। রাতেও নিস্তার মিলত না স্বামীর কাছ থেকে। তবুও জানকীর পোয়াতি শরীরটা বোধ হয় একঘেয়ে হয়ে গেছিল ওর স্বামীর। ”মা হতে চলেছে” – এই অজুহাতে চোদ্দ বছরের জানকীকে পাঠিয়ে দেওয়া হল তার বাপের ঘরে। যাওয়ার আগে অবশ্য জানকী জেনে গেল ওর সোয়ামী আবার বিয়ে করে চলছে মোটা অঙ্কের দহেজ নিয়ে।
একটা ছেলের জন্ম দিল জানকী। রুগ্ন,কিন্তু গলার এত জোর! খিদের জ্বালায় চিৎকার করে মাথায় তোলে। পাশের গ্রামে এক বাড়িতে কাজ নিল জানকী। জায়গা জমি আছে , উপাধ্যায় বাবুরা সাত্ত্বিক ব্রাহ্মণ। ঘরের কাজ। থালা বাসন মাজবে, জল তুলবে আর ছোটখাট হুকুম তামিল করবে। ঘরের বাইরে বের হতে হবে না। বিনিময়ে কিছু টাকা আর একবেলার খাবার। মন্দ কি! ভালোই চলছিল। নিজের পেট আর ছেলের পেটের এর থেকে ভালো সংস্থান আর কি হতে পারে? চেহারা ক্রমশ ডাগর হয়ে উঠল জানকীর। ষোলো বছরের উপছে পড়া যৌবন ধরা পড়ল উপাধ্যায় বাবুর ছোট ছেলের চোখে। টানতে টানতে একদিন ওকে নিয়ে গেল খড়ের গাদায়। কামনা  চরিতার্থ করে ওর হাতে গুঁজে দিল একশ টাকার নোট। আর একটা রোজগারের রাস্তা খুলে গেল জানকীর। এভাবেই বেশ চলছিল ।

মহুয়ার ফল সদ্য পেকেছে সে সময়। জানকী ভোররাতে উঠে জঙ্গলে গেছিল মৌ-ফল কুড়োতে। ফল কুড়োতে কুড়োতে কখন যে ভেতর দিকে ঢুকে পড়েছিল খেয়াল করেনি। পিঠের ওপর  হাতের একটা চাপড় খেয়ে পেছন ফিরল জানকী আরে! এতো সন্তোষ!
”তুই কোথা থেকে এলি! তোকে তো তোর বাপ মা খুঁজে খুঁজে হয়রান। সবাই বলে তুই জঙ্গীদলে নাম লিখিয়েছিস।” চেঁচিয়ে ওঠে জানকী।
-ঠিকই বলে। ওখানে গেলে তো খাবার জোগারের  চিন্তা নেইরে। আর ওরা আমাদের শেখাচ্ছে বড়লোকেদের হাত থেকে কিভাবে নিজেদের হক বুঝে নিতে হয়। ওরা জঙ্গী নয়। ভালো মানুষ।

-খাবার জোগারের চিন্তা নেই!

– না নেই। ওরাই সব দেয়। তুই যাবি আমার সঙ্গে?
জানকী রাজি হয়ে যায় সঙ্গে সঙ্গেই। ওখানে গিয়ে রান্নার কাজ পায় ও। তারপর দলের কাজ কর্মের সঙ্গে পরিচিত হতে হতে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে সবার সঙ্গে। শুধু রান্না নয়, অস্ত্রচালনাতেও দক্ষ হয়ে উঠতে থাকে জানকী। অহমিয়া এরিয়া কমান্ডার বিজয় বড়ুয়ার খুব কাছের পাত্রী হয়ে ওঠে জানকী। অতি দ্রুত গতিতে  নিজেকে গোপন রেখে গাছ থেকে গাছে চলাচল করার মতো দক্ষতা ওর মতো কারোর নেই। জানকী আর এক কারনেও দলে অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল। এতগুলো পুরুষ মানুষের যৌনতৃষ্ণা মেটানোর দায়িত্বও ছিল ওর ওপর। আর সে কারনেই ধরা পড়ার সময়ে  জানকী ছিল প্রেগন্যান্ট।

এবার থামলেন মিঃ আগর ওয়াল। আমি জানতে চাইলাম ,”বাচ্চাটা নষ্ট হল কি করে?”
বললেন,” ওর কাছে দলের অনেক খবর আছে। দলের আগামী অপারেশনের ব্লু প্রিন্ট ও জানে। জানকী হল এরিয়া কমান্ডারের দক্ষিণ হস্ত, ছায়াসঙ্গিনী। তাই নানাভাবে চেষ্টা করা হয়েছে কথা আদায় করার। আর তাতেই বাচ্চাটা ….। জানেন, একটা কথাও ওর মুখ থেকে বের করা যায় নি।”

কোসমা ফিরে যাচ্ছি। রাঁচি ছাড়িয়ে গাড়ি ছুটে চলেছে বড় রাস্তা ধরে কোডারমার পথে।  জাতীয় সড়কের পাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে  শাল ,বাবুল ,শিমূলগাছ গুলো প্রবল বেগে মাথা নাড়ছে। আকাশ জুড়ে জটাধারী কালো মেঘ  ছুটোছুটি করে ভিড় জমাতে শুরু করেছে। কড়্ কড়্ কড়াৎ শব্দে আকাশে থেকে ঐ কালো মেঘের বুক চিরে এঁকে বেঁকে ধানকাটা রুক্ষ জমিতে  নেমে আসছে বিদ্যুতের ফলা। আলের পথে দ্রুত পায়ে মোষগুলোকে তাড়িয়ে  নিয়ে ঘরে ফিরছে চাষী। গ্রামের সরু পথ ধরে গরুর গাড়িটা যেন দ্রুত চলতে চাইছে। কালবৈশাখীর সাথে বৃষ্টি আসছে শুকনো রুক্ষ মালভূমির বুকে। বৃষ্টি আসছে দূর থেকে। গ্রাম পেরিয়ে,তাল-খেজুরের পাতা ধুয়ে, শালগাছের মাথা ছুঁয়ে , ফুটিফাটা ধানক্ষেতকে ভিজিয়ে দিয়ে। গাড়ির জানার কাঁচ পেরিয়ে আমার গালে কপালে স্পর্শ করল বৃষ্টির ফোঁটা। হু হু করে ছুটে আসা ঝড় আছড়ে পড়ল আমার বুকের গভীরে। বৃষ্টির জলের সাথে আমার চোখের জল কখন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে বুঝতে পারিনি। কালো মেঘে  চমকে ওঠা বিদ্যুত নাকি  জানকীর ক্ষণিকের জন্য জ্বলে ওঠা শ্রান্ত ক্লান্ত দুটো চোখ!শো শো ঝড়ের শব্দের সাথে  আকাশজুড়ে ছুটে বেড়াচ্ছে একটা কন্ঠস্বর  -”আমার শরীরটা  ভাল নেই বাবু।”

Related Posts

MHA-extends-Lockdown
Main

MHA extends Lockdown till May 17, lists relaxations for less-affected areas

May 1, 2020 - Updated on July 19, 2025
People flooded social media responding #TripuraWearsMask call
Old Archive

People flooded social media responding #TripuraWearsMask call

April 30, 2020 - Updated on July 19, 2025
MBB-Airport-Tripura
North East

AAI HQ yet to decide flight sequence for MBB Airport Agartala

April 30, 2020 - Updated on July 19, 2025
Covid19-Vehicle-Santization-Tunnel-Tripura
North East

Covid19 war in Tripura: Vehicle Santization Tunnel set up

April 30, 2020 - Updated on July 19, 2025
DU-Harvard-University
India

Amid Covid19 gloom: DU students win Global Case Competition at Harvard

April 30, 2020 - Updated on July 19, 2025
All-Party-meet-Covid19-Tripura
North East

Lockdown blues: Tripura Govt to procure paddy through FCI

April 30, 2020 - Updated on July 19, 2025
ADVERTISEMENT
ADVERTISEMENT
ADVERTISEMENT
ADVERTISEMENT
D-2050 D-2050 D-2050
ADVERTISEMENT
ADVERTISEMENT
ADVERTISEMENT

About us

Enewstime.in is run by an individual – a Journalist by profession of Tripura with the active help of several journos including senior journalists of the State. On top of that, Enewstime.in being a subscriber of IANS news agency, we have plenty of multi-choice topics to offer to our esteemed readers. Enewstime.in is a venture reach global audience from a tiny State Tripura.

Latest News

BJP’s ally, TIPRA Motha Stages Delhi Protest Over 3-Point Demands

C P Radhakrishnan elected new Vice President

Canada risks facing same fate as Pakistan by promoting Khalistani terror groups: Report

PM Modi announces assistance of Rs 1,600 crore for flood-hit Punjab

Crisis-prone Nepal plunges deeper into chaos after PM Oli's resignation

Gen-Z Uprising in Nepal Forces PM Oli to Step Down

Contact us

19, Old Thana Road. Banamalipur. PO. Agartala. Pin code 799001. Tripura (West), India.

Email: enewstime2017@gmail.com

Wa: 8794548041

  • Contact us
  • Advertising Policy
  • Cookie Policy
  • Disclaimer
  • Privacy Policy
  • Terms of Use

© 2025 Designed & Developed with ❤️ by Provibe Media LLP

Welcome Back!

Login to your account below

Forgotten Password?

Retrieve your password

Please enter your username or email address to reset your password.

Log In
No Result
View All Result
  • Home
  • News
    • Northeast
    • National
    • International
    • Tripura News
  • Sports
  • Business
  • Entertainment
  • Health
  • Features
  • Tenders
  • More
    • Old Archive

© 2025 Designed & Developed with ❤️ by Provibe Media LLP