Paramita Gharai
December 21, 2018: ঘাড়ের ওপর জলের ফোঁটা পড়তেই ঘুম ভেঙে গেল শালিকের। ল্যাম্পপোস্টের আলো যাতে চোখে না পড়ে এমন একটা জায়গা বেছেছে ওরা দিন কয়েক হল। ওরা মানে শালিক আর শালিক গিন্নি। বাইপাসের ধারে বিশাল এই আমগাছটার ঝাঁকড়া পাতাগুলোর আড়ালে গুছিয়ে বসেছে ওরা। বদমাশ কাক গুলোও হদিশ পায়নি জায়গাটার। পেলেই তাড়িয়ে দেবে। শালিক আর শালিক গিন্নির ইচ্ছে এবারের শীতটা এখানেই কাটাবে। পালক ফুলিয়ে বেশ ঘুমোচ্ছিল দুজনে। হঠাৎই বৃষ্টির ফোঁটা ঘাড়ে এসে পড়াতে ঘুম ভেঙে চমকে উঠল কর্তা শালিক। গিন্নির দিকে তাকিয়ে দেখল সেও উশখুশ করছে। একটু পরেই চোখ খুলে বলল, ”কি ব্যাপার বলো তো কর্তা? এই শীতে বৃষ্টি! আমরা এখন যাব কোথায়?”
আম গাছটার নীচেই একটা চা-এর দোকান। সকালবেলা ওখানে উড়োউড়ি করলে দু-চার টুকরো বিস্কুট পাউরুটি পাওয়া যায়। ইটগাঁথা দেওয়ালের ওপর বাঁশের ফ্রেম, তারওপর পরপর টালি বসিয়ে দোকানের ছাদ।
বৃষ্টির তোড় ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। ঠান্ডাতে আর বৃষ্টিতে কর্তা -গিন্নি দুজনেই ঠকঠকিয়ে কাঁপছে। ”চলো গিন্নি, ঐ দোকানটায় গিয়ে ঢুকি।” কর্তা শালিক বলল।
গিন্নি শালিক বলল, ”যদি তাড়িয়ে দেয়। তার চেয়ে এখানেই থাকি।”
– না গো, এখানে থাকলে দুজনেই মরে যাব।
– তাহলে চলো, একবার গিয়ে দেখি।
কোনরকমে ডানা ঝাপটে ইটের গাঁথুনি আর টালির ফাঁক দিয়ে দুজনে ঘরে ঢোকে। একটা বাঁশের ফ্রেমের একটা ধারে গিয়ে দুজনে বসল। উফ! কি সুন্দর গরম। আর ঘরেও কেউ নেই। দুজনে নিশ্চিন্তে চোখ বুজল। ….
অনেক ভোরে যখন ঘুম ভাঙলো তখন পূবের আকাশে লালচে আভা। আশপাশে সঙ্গী পাখিদের কলতান। ওরা ঘর থেকে বাইরে এসে আমগাছটার ডালে এসে বসল।
২
শীতের রাতগুলো আর আমগাছটার ডালে থাকে না শালিক-দম্পতি। সন্ধ্যে হলেই সোজা টালির ছাদ আর ইটের দেওয়ালের ফাঁক গলে টুক করে ঢুকে পড়ে চায়ের দোকানে। রাতের বেলায় নিশ্চিন্তে ঘুমোয় ওরা। ঠান্ডার হাত থেকে যেমন রক্ষা, তেমনি কাক, চিল, শকুন, পেঁচা সকলের হাত থেকেই নিরাপদ।
সেদিনও নিয়মমাফিক চায়ের দোকানে ঢুকে বাঁশের ওপর বসেছে ওরা। ঘুমিয়েও পড়েছে। হঠাৎই ”খসখস” করে একটা শব্দ। ঘুম ভেঙে গেল শালিক-গিন্নির। প্রথমে আমল দিল না। কিন্তু শব্দটা ক্রমাগত হয়েই যাচ্ছে। হঠাৎই খট্ করে একটা শব্দ। সজাগ হয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো শালিক-গিন্নি।
তারপর যা দেখল তাতে তো শালিক-গিন্নির আক্কেল গুড়ুম। শালিক কর্তারও ঘুম ভেঙে গেছে শব্দে। চোখ খুলে সেও মূর্তিমান শয়তানকে দেখে চিৎকার করে উঠতে যাচ্ছিল। শালিক-গিন্নি চোখ বড় করে ডানা দুটো নিঃশব্দে ঝাপটালো একবার। শালিক কর্তা নিজেকে সামলে নিল।
পুরো মুখ কেটলিতে ঢুকিয়ে চুকচুক শব্দে কি যেন খেল শয়তানটা। কিন্তু তারপর খুট খাট শব্দ করে কেটলিটাকে মাথায় নিয়ে ঘরের মধ্যে এদিক ওদিক দৌড়াদৌড়ি করতে শুরু করল। কখনো লাফিয়ে চেয়ারে বেঞ্চে উঠতে লাগলো। কখনো বা মেঝেতে লাফিয়ে নামতে লাগল। সে রাতে কর্তা-গিন্নি চোখের পাতা আর এক করতে পারল না।
ভোরের আভাস পেতেই, অন্ধকার থাকতে থাকতেই সাবধানে বের হয়ে এল ঘরটা থেকে। আমগাছটার ডালে আগের জায়গায় ফিরে অপেক্ষা করতে লাগলো সূর্য উঠবার ।
ইতিমধ্যে দোকানের মালিক এসে দরজার তালা খুলল। দরজা খুলেই তো তাল আক্কেল গুড়ুম। গতরাতে সে দুধ জ্বাল দিয়ে রেখে গেছে। প্রতি রাতেই সে তাই করে, যাতে ভোরবেলাকার খদ্দেরদের তাড়াতাড়ি চা দিতে পারে। ”এই হতচ্ছাড়া বেড়াল!” হাতের সামনে দরজার খিলটা ছিল। সেটা তুলে নিয়ে মারতে গিয়ে থেমে গেল দোকানী। বেড়ালটার মাথা কেটলির ভেতর আটকে আছে। মানে দুধ খাবার জন্য মাথাটা ঢুকিয়ে দিয়েছিল বেড়ালটা। কিন্তু খাবার পরে কানদুটোর জন্য আর মাথাটাকে বের করতে পারে নি হতচ্ছাড়া। মারতে গিয়ে দয়া হল দোকানীর।
বেড়ালটার দুটো ঠ্যাং ধরে পিচের রাস্তার ওপর কাপড় কাচার মতো তিন-চার বার আড়ং ধোলাই দিতেই কেটলি বেড়ালের মাথাটা থেকে খুলে ছিটকে গড়িয়ে পড়ল রাস্তার একধারে। দোকানীও বেড়ালটার ঠ্যাং দুটো ছেড়ে দিল। ছাড়া পেয়েই বেড়ালটা ওখান থেকে পোঁ পাঁ দৌড়। আর পেছনে ফিরে তাকালো না।
আমগাছের ডালে বসে পুরোটাই দেখল শালিক দম্পতি। হাসতে হাসতে ওদের পেটে খিল লাগার জোগার। যাক্, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল বেড়াল বাবাজী আর কখনো কোনোদিনও এ-মুখো হবে না। ওদের রাতের ঘুমানোর জায়গা নিরাপদ রইলো।
বেলা বেড়ে গেছে। লোকজনের চলাচল শুরু হয়েছে। শালিক দম্পতি খাবারের খোঁজে এবার ডানা মেলল।