Pro-MASS Feature Service: Jan 1, 2016:
* গার্গী পারসাই
ব্যাপক চাহিদা ও যোগানের মধ্যে ঘাটতি থাকার দরুণ বিভিন্ন ডালশস্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারের একাধিক পদক্ষেপের মতো বিষয়গুলি নিয়েই ২০১৫-তে খাদ্য ক্ষেত্রে সবথেকে বেশি চর্চা হয়েছে। অন্যদিকে, কেন্দ্রীয় সরকারের ধারাবাহিক প্রচেষ্টার ফলে বছরের শেষ দিকে ২৫-টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা আইন রূপায়ণ করা সম্ভব হয়েছে। এই আইন রূপায়ণের ফলে মোট বৈধ উপভোক্তার প্রায় ৬৭ শতাংশ রেশন দোকানের মাধ্যমে উচ্চ-ভর্তুকিপ্রাপ্ত মূল্যে বিভিন্ন ধরনের খাদ্যশস্য পাচ্ছেন। বাকি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলি আগামী মার্চ মাস নাগাদ এই আইন নিজেদের রাজ্যে কার্যকর করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
সদ্য সমাপ্ত বছরটিতে (২০১৫) সরকার তুর ও উরাদ ডালের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। চাহিদা ও যোগানের মধ্যে ব্যাপক ফারাক থাকার দরুণ এবং আন্তর্জাতিক বাজারেও পর্যাপ্ত যোগানে ঘাটতি থাকায় ডালের দামে অতিরিক্ত প্রভাব পড়েছে। দেশে বিভিন্ন ধরনের ডালের উৎপাদন ২০১৩-১৪-এর ১৯.২৫ মিলিয়ন টন থেকে কমে ২০১৪-১৫-তে ১৭.২০ মিলিয়ন টনে পৌঁছেছে। প্রায় দুই টন ডালের উৎপাদন কম হওয়ার পিছনে রয়েছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের খরাজনিত পরিস্থিতি। দেশে বিভিন্ন ধরনের ডালশস্যের পর্যাপ্ত পরিমাণে যোগান বাড়াতে এবং মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে ২০১৪-১৫-তে ৪.৫৮ মিলিয়ন টন এবং ২০১৫-এর অক্টোবর পর্যন্ত ২.৭৮ মিলিয়ন টন ডাল আমদানি করা হয়। কাবুলি চানা ও জৈব-ডাল বাদে দেশ থেকে সব ধরনের ডালশস্য রপ্তানি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ডাল আমদানিতে শুল্ক ছাড়ের অনুমতি বজায় রয়েছে। সরকার ৫ হাজার টন তুর ডাল আমদানি করে কেন্দ্রীয় ভাণ্ডার ও সকল খুচরো বিপণন কেন্দ্রের মাধ্যমে বাজারদরের তুলনায় কম দামে, ১২০ টাকা কিলো দরে দিল্লিতে বিক্রয় করেছে। পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করে যখন আন্তর্জাতিক বাজারেও তুর ও উরাদ ডালের যোগান কম পেতে থাকে। ডালশস্য উৎপাদনকারী বিভিন্ন দেশে খরাজনিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে, সেখানেও উৎপাদন ব্যবস্থা প্রভাবিত হয়।
সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে এক বছর আগের তুর ডালের দাম কিলোপ্রতি ৭৫.৬৬ টাকা থেকে বেড়ে ১৯৮ টাকায় পৌঁছেছে। উরাদ ডালের দামও একইভাবে কিলোপিছু ৭৫.৮১ টাকা থেকে বেড়ে ১৪৪ টাকা হয়েছে। শুধু তাই নয়, ছোলার ডালের দাম ৫১.৬৭ শতাংশ, মুগ ডালের দাম ১৩.২৭ শতাংশ এবং মুসুর ডালের দামও ২২.৩৬ শতাংশ হারে হারে বিগত এক বছরে বেড়েছে।
এই পরিস্থিতির আরও কার্যকর মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য খাদ্যমন্ত্রীদের জরুরি ভিত্তিতে বৈঠক আহ্বান করে। বৈঠকে রাজ্যগুলিকে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন আরও কার্যকরভাবে বলবৎ করার জন্য এবং মজুতদার ও কালোবাজারিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়। অতিরিক্ত ডালশস্য মজুত রাখার ক্ষেত্রেও বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। আমদানি করা ডালশস্যের ক্ষেত্রে একই ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। বিভিন্ন রাজ্য অবৈধভাবে মজুত রাখা ডালশস্য বাজেয়াপ্ত করার জন্য তল্লাশি চালিয়ে প্রায় ১ লক্ষ ৩০ হাজার টন বিভিন্ন ধরনের ডাল উদ্ধার করেছে।
ডালশস্যের মূল্যবৃদ্ধি রুখতে, সরকার তুর ও উরাদ ডালের ১ লক্ষ ৫০ হাজার টনের মজুতভাণ্ডার গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। খরিফ ও রবি বিপণন মরশুম থেকে বাজারদরে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ঐ ডাল সংগ্রহ করা হবে। মজুত করা এই ডালের বিক্রয় মূল্য কি হবে তা এখনও ঠিক হয়নি, কারণ খুচরো বা খোলা বাজারের সিংহভাগই নিয়ন্ত্রিত হয় বেসরকারি হাতে।
বিভিন্ন ধরনের ডালশস্য চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করতে খরিফ বিপণন মরশুমে ডালের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ক্যুইন্টাল প্রতি ২৭৫ টাকা বাড়ানো হয়েছে। অবশ্য, ডালশস্যের রপ্তানি ও অবৈধ মজুতভাণ্ডার গড়ে তোলার ওপর নিষেধাজ্ঞা যথারীতি বজায় রয়েছে। নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখার এই সিদ্ধান্তই ইঙ্গিত দেয় যে, পরিস্থিতি এখনও সন্তোষজনক নয়। আগামী বছরগুলিতে এই ধরনের জটিল পরিস্থিতির যাতে উদ্ভব না হয়, তার জন্য উপযুক্ত সমন্বয় গড়ে তুলতে খাদ্য, কৃষি, বাণিজ্য ও রাজস্ব দপ্তরকে নিয়ে একটি আন্তঃমন্ত্রক গোষ্ঠী গঠিত হয়েছে। এই গোষ্ঠী বাজারে পেঁয়াজের দামের ওপরও নজর রাখবে এবং যোগান ও আমদানির বিষয়ে আগাম সিদ্ধান্ত নেবে।
গত বছর সরকার আখচাষী ও আখমাড়াই কলগুলির স্বার্থে বেশ কয়েকটি কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে। দেশীয় বাজারে চাহিদা পড়ে যাওয়ার দরুণ আখমাড়াই কলগুলিতে অতিরিক্ত চিনি জমা হতে থাকে। এর ফলে, আখচাষী ও কল মালিক উভয়ই বড় আর্থিক সমস্যার মধ্যে পড়েন। জটিল এই সমস্যার মোকাবিলা করতে সরকার বকেয়া টাকা মেটানোর উদ্যোগ নেয়। এই উদ্যোগের ফলস্বরূপ বকেয়া দেনার পরিমাণ গত বছরের মার্চ-এপ্রিলের সময় ২১ হাজার কোটি টাকা থেকে কমে বর্তমানে ৫ হাজার ৪০৬ কোটি টাকায় এসে দাঁড়িয়েছে।
প্রায় রুগ্ন হয়ে পড়া চিনি শিল্পের পুনরুজ্জীবনে ও আখচাষীদের কিছুটা রেহাই দিতে সরকার সহজ শর্তে চিনি শিল্পগুলিকে ৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সেইসঙ্গে, এই শিল্পগুলির বকেয়া ৬০০ কোটি টাকা সুদ ছাড় দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই ৬ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ৪ হাজার ৪৭ কোটি টাকা চিনি কলগুলিকে আখচাষীদের প্রাপ্য বকেয়া মেটানোর জন্য দেওয়া হয়েছে। আরও সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, বকেয়া দেনা মেটানোর পর বাকি টাকা চিনি কলগুলির ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা করে দেওয়া হবে। এই সিদ্ধান্তের ফলে অতিরিক্ত ১৫০-টি চিনি কল আখচাষীদের কাছে বকেয়া টাকা মেটাতে সক্ষম হয়ে উঠবে।
এছাড়াও, সরকার আখ উৎপাদকদের ২০১৫-১৬ মরশুমে ক্যুইন্টাল প্রতি ৪.৫০ টাকা হারে উৎপাদন সংযুক্ত ভর্তুকি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই ভর্তুকিবাবদ সরকারের আনুমানিক ১ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা খরচ হবে। এমনকি, চিনি আমদানিকে অনুৎসাহিত করতে সরকার আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪০ শতাংশ করেছে।
চিনিক্ষেত্রকে সহায়তার জন্য আরও একটি বড় পদক্ষেপ হিসেবে সরকার আগামী চিনি মরশুম থেকে পেট্রোলিয়ামের সঙ্গে মেশানোর জন্য ইথানলের ওপর থেকে অন্তঃশুল্ক প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর ফলে, চিনি কলগুলির যে আর্থিক লাভ হবে তা দিয়ে তারা আখের বকেয়া দাম মেটাতে পারবে। পেট্রোলিয়ামের সঙ্গে মেশানোর জন্য সরবরাহকৃত ইথানলের পারিশ্রমিকের হার বাড়িয়ে লিটারপ্রতি ৪৯ টাকা করা হয়েছে।
গত বছরের গোড়ার দিকে ভারতীয় খাদ্য নিগমের (এফ সি আই) পুনর্গঠন সংক্রান্ত সমীক্ষা্রপ্রতিবেদন শ্রী শান্তা কুমারের নেতৃত্বে গঠিত উচ্চস্তরীয় কমিটি জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনের অন্যতম একটি সুপারিশ ছিল, সুনির্দিষ্ট গণবন্টন ব্যবস্থার উপভোক্তাদের সংখ্যা সীমিত রাখা। কিন্তু, সরকার কমিটির এই প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, উপভোক্তারা খাদ্যশস্যের পরিবর্তে নগদ অর্থ নিতে অনিচ্ছুক। সম্প্রতি একটি মিল মালিক সংগঠনের পক্ষ থেকেও খাদ্যশস্যের অপচয় রোধে নগদ অর্থ হস্তান্তর প্রস্তাবের বিরোধীতা করেছে। সরকারি সূত্রে জানানো হয়েছে, অধিকাংশ রাজ্যেই গণবন্টন ব্যবস্থার ডিজিটালকরণের ফলে খোলা বাজারে ভর্তুকিপ্রাপ্ত খাদ্যশস্যের প্রবাহ হ্রাস পাবে। জাল রেশন কার্ড বাতিল করার ক্ষেত্রে কম্পিউটারচালিত পদ্ধতি প্রবর্তন বিশেষভাবে সাহায্য করেছে।
ভারতীয় খাদ্য নিগমের (এফ সি আই) কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণে (ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৫০ মিলিয়ন টন) খাদ্যশস্যের মজুতভাণ্ডার তৈরি হওয়ায় সরকার মজুতভাণ্ডারের পরিমাণে সংশোধনের সিদ্ধান্ত নেয়। উদ্দেশ্য হল, অতিরিক্ত মজুত ক্ষমতা গড়ে তোলা, উত্তর-পূর্বে খাদ্যশস্যের স্বাভাবিক সরবরাহে নজর দেওয়া এবং পরিবহণ খরচ সহ মজুতভাণ্ডারে অপচয় হ্রাস করা।
আরও বেশি সংখ্যক কৃষক ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের সুবিধা পৌঁছে দিতে এবং ধান সংগ্রহের পরিমাণ বাড়াতে অসম, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড ও পশ্চিমবঙ্গ সরকার বেসরকারি ক্ষেত্রকে উৎপাদকদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহে অনুমতি দিয়েছে। এই রাজ্যগুলির যেসব জায়গায় এফ সি আই-এর পক্ষ থেকে ধান সংগ্রহের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেই, সেখান থেকেই বেসরকারি ক্ষেত্র সরকার চিহ্নিত ক্লাস্টারের মধ্যে ধান সংগ্রহের অনুমতি পেয়েছে। কৃষকদের হতাশা যাতে চরম পর্যায়ে না পৌঁছায়, তার জন্যই এই সিদ্ধান্ত। সংগৃহীত ধান বেসরকারি এজেন্সিগুলি কেন্দ্রীয় খাদ্য নিগম বা রাজ্য সরকারের মজুতভাণ্ডারে সরবরাহ করবে।
গুণমান ও পরিষেবার দিক থেকে ক্রেতা-স্বার্থ সুরক্ষায় উপভোক্তা বিষয়ক দপ্তর ভারতীয় মানক ব্যুরোর (বি আই এস) প্রায় তিন দশকের পুরনো নির্দিষ্ট কিছু নিয়মাবলী পরিবর্তন করেছে। পণ্যের গুণমান বজায় রাখতে স্বপ্রত্যয়ন ব্যবস্থা আরও সরল করতে, হলমার্ক ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করতে এবং পণ্যের দায়বদ্ধতা সুনিশ্চিত করতেই এ ধরনের পদক্ষেপ। বাধ্যতামূলক প্রত্যয়ন ব্যবস্থার আওতায় স্বাস্থ্য, সুরক্ষা, পরিবেশ, অসাধু পন্থা বর্জন প্রভৃতি বিষয়কে নিয়ে আসা হয়েছে। মূল্যবান ধাতব সামগ্রীর ক্ষেত্রে ‘হলমার্ক’ ছাপ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
আরও একটি কার্যকর ও তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে সরকার ক্রেতা সুরক্ষা আইন সংশোধন করে একটি কেন্দ্রীয় সুরক্ষা কর্তৃপক্ষ স্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছে। এই কর্তৃপক্ষের হাতে বাজার থেকে প্রয়োজনে পণ্য ফিরিয়ে নেওয়া এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহনের ক্ষমতা থাকবে। ক্রেতা আদালতে ই-অভিযোগ দাখিল ও সময়মতো নিষ্পত্তির জন্য উপযুক্ত কাঠামো গড়ে তোলারও প্রস্তাব করা হয়েছে। বকেয়া মামলাগুলির সমাধানে জাতীয় ক্রেতা আদালতে বিভিন্ন প্রয়াস গ্রহণ করা হচ্ছে।
বিভ্রান্তিকর বিজ্ঞাপনগুলির মোকাবিলায় ক্রেতা বিষয়ক দপ্তর www.gama.gov নামে একটি ওয়েবসাইট চালু করেছে। এই ওয়েবসাইটটির মাধ্যমে বিভ্রান্তিকর বিজ্ঞাপনগুলির বিরুদ্ধে ক্রেতারা অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন।