পার্থ ঘোষ
নারকেল হল এমনই এক ফল, ভারতে যার সমাদর প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই। নারকেল গাছ দেশের উপকূলবর্তী বিভিন্ন রাজ্য, পুবের পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা থেকে শুরু করে দক্ষিণের কেরল, অন্ধ্র, তেলঙ্গানা, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক ও পশ্চিমের গোয়া, মহারাষ্ট্রে চোখে পড়ে। দেশের দুই দ্বীপপুঞ্জ, (http://www.enewstime.in/?p=978) আন্দামান-নিকোবর ও লক্ষদ্বীপেও নারকেল গাছের সংখ্যাধিক্য চোখে পড়ার মত। রামায়ণের কালের লঙ্কা দ্বীপের বর্ণনা দিতে গিয়ে মহাকবি কালিদাস লিখেছিলেন, ‘তমালতালীবনরাজিনীলা’। এর মধ্যে নারকেল গাছের উল্লেখ না থাকায় অবাক হওয়ার কিছু নেই, কেননা বৈজ্ঞানিক মতে নারকেল গাছ হল তাল প্রজাতির। আর তাই ওই তালী শব্দের মধ্যে লুকিয়ে আছে নারকেল গাছের কথাও।
সেই কারণেই তাল রসের মত নারকেলের রসও যে সুস্বাদু হবে, এই অনুমান থেকেই কৃষি বিজ্ঞানীরা নারকেল গাছেও রসের সন্ধান শুরু করেন। নারকেলের ফুল বা মুচি থেকে মেলে তাঁদের কাঙ্খিত রস, যার নাম দেওয়া হয় নীরা। (http://www.enewstime.in/?p=978) এই নীরা সুস্বাদু তো বটেই, আর সেই সঙ্গে নানা পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধও বটে। আর সেই জন্যই কৃষি বিজ্ঞানীরা নারকেল গাছের এই নতুন সম্পদটির উপযুক্ত সদ্ব্যবহারের পথ খুঁজে নিচ্ছেন ভারতের নানা রাজ্যে।
ভারতের ৯টি রাজ্য ও ৩ কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলের প্রায় ১৮ লক্ষ ৯৫ হাজার হেক্টর জমিতে নারকেলের চাষ হয়ে থাকে। প্রতি হেক্টর জমিতে প্রায় ৯ হাজার নারকেল পাওয়া যায়। (http://www.enewstime.in/?p=978) অর্থকরি ফসল হিসেবে নারকেল যার বৈজ্ঞানিক নাম কোকোস নুসিফেরা, বিশেষ জনপ্রিয়। সাধারণত দুই প্রজাতির নারকেল পাওয়া যায়, যার একটি দীর্ঘ এবং অন্যটি হ্রস্ব প্রজাতির। দীর্ঘ প্রজাতির একটি গাছে বছরে ৭৫টি পর্যন্ত নারকেল হতে পারে। দক্ষিণের চারটি রাজ্যে দেশের মোট নারকেলের প্রায় ৯২ শতাংশেরই ফলন হয় । এর মধ্যে সর্বাধিক হল কেরলে, ৪৫.২২ শতাংশ। গোয়া, মহারাষ্ট্র, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ত্রিপুরা ও অসম মিলিয়ে মোট উত্পাদন দাঁড়ায় ৮.৪৪ শতাংশ। পশ্চিমবঙ্গে অবশ্য বিভিন্ন জেলাতেই নারকেলের চাষ দেখা যায়।
বিধান চন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যান পালন বিভাগ ভারতীয় কৃষি গবেষণা পর্ষদ (আই.সি.এ.আর.)-এর আওতাধীন সেন্ট্রাল প্ল্যান্টেশন ক্রপস রিসার্চ ইন্সটিটিউট-এর উত্সাহে বর্তমানে নারকেল ফুলের রস নীরা উত্পাদনের একটি দিশারী প্রকল্প গ্রহণ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব খামার মন্ডৌরিতে বিভাগের অধ্যাপক দীপক ঘোষ নারকেল গাছের ফুল থেকে রস বের করার প্রক্রিয়া শুরু করেন। পরে, হুগলীর বলাগড়ের বাকুলিয়ায় দেবব্রত ঘোষের নারকেল বাগানে আগস্ট মাসের শেষ নাগাদ এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। গত মাসের মাঝামাঝি নারকেল গাছের রস নীরার উত্পাদন শুরু হয়। প্রতিটি গাছ থেকে দুবেলায় গড়ে ১ লিটার নীরা পাওয়া যাচ্ছে। পীতাভ এই রসটি পাওয়া যায় নারকেল গাছের ফুল বা মুচিকে বিশেষ কায়দায় একত্রে বেঁধে রেখে ম্যাসাজ করলে। (http://www.enewstime.in/?p=978) রস বিশেষ ধরনের এক আধারে সংগ্রহ করে ঠান্ডায় রাখতে হয় গেঁজে যাওয়া ঠেকাতে। এই রসে আয়রন, জিঙ্ক, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম প্রভৃতি খনিজ ছাড়াও আছে পলিফেনল, নানা ধরনের ভিটামিন এবং বেশকিছু ধরনের ফ্যাটি অ্যাসিড। এছাড়া এরমধ্যে ইনিউলিন নামে একটি বিশেষ ধরনের ফাইবার বা তন্তু থাকায় এটি অন্তর্গত শর্করা বা গ্লুকোজকে রক্তে মিশতে বাধা দেয়। নীরায় তার ওপর অন্যান্য ফলের মত ফ্রুকটোজ না থাকায় নীরার গ্লাইসেমিক কনটেন্ট বা শর্করা মাত্রা কম হওয়ায় ডায়াবেটিকদের পক্ষে এই রস খাওয়া স্বাস্থ্যপ্রদ, কেননা অন্যান্য ফলের রস তারা পান করতে পারেন না, ফ্রুকটোজ থেকে শর্করার মাত্রা বেড়ে যাওয়ার ভয়েই। এছাড়া গর্ভবতী মহিলাও নীরা থেকে সহজে প্রয়োজনীয় পুষ্টি ও খনিজ ইত্যাদি পেতে পারেন বলে তাদেরও এই রস পান করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
একটি নারকেল গাছ থেকে বছরে যে নারকেল পাওয়া যায়, তার দাম গড়ে ২ থেকে আড়াই হাজার টাকা। অথচ ওই গাছটি থেকে বছরে অন্তত ৩শো লিটার নীরা পাওয়া যেতে পারে। খেজুর বা তাল গাছের মত নারকেল গাছের রস সংগ্রহ করার কোন নির্দিষ্ট সময়সীমা বা মরশুম না থাকায় সারা বছরই নীরা পাওয়া যায়। তবে, যে গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা হবে সেই গাছের ফল পাওয়া যাবে না । পশ্চিমবঙ্গে সব মিলিয়ে ২.৯৩ লক্ষ হেক্টর জমিতে নারকেল চাষ হয়। হেক্টর পিছু ১৭৫টি গাছ হয়, অর্থাত মোট গাছের সংখ্যা ৫কোটি ১২ লক্ষেরও বেশি । প্রকৃতির নিয়মেই ৫ শতাংশ গাছ বন্ধ্যা হয়, অর্থাত্ ওইসব গাছে কেবল ফুল হয় কিন্তু ফল হয় না। (http://www.enewstime.in/?p=978) মাত্র ১ শতাংশ গাছেও যদি রস নেওয়া যায় তাহলে তার সংখ্যা দাঁড়াবে ৫ লক্ষেরও বেশি এবং এক্ষেত্রে দিনে ২ লক্ষ ৩৬ হাজার অতিরিক্ত শ্রম দিবস সৃষ্টি হওয়ার কথা, কেননা ১ জন শ্রমিক গড়ে ১৫ থেকে ২০টি গাছে দৈনিক রস সংগ্রহ করতে পারে। এই পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায় যে, নীরা উত্পাদনের ফলে চাষী ছাড়াও কৃষি শ্রমিকরাও কিভাবে লাভবান হবেন। অন্যদিকে, প্রতি লিটার নীরার অর্থমূল্য গড়ে ৬০ টাকা হলে কেবল এই নীরা বেচেই একজন নারকেল চাষী বছরে প্রায় ২০ হাজার টাকা মত বাড়তি আয় করতে পারেন। অন্যদিকে, দক্ষিণ ভারতে এই নীরাকে মিষ্টি খাবার তৈরীর কাজেও ব্যবহার করা হয়। একইভাবে এরাজ্যে চেষ্টা করা হলে তা হবে ডায়াবেটিক রোগীদের পক্ষে বিশেষ সুখবর।
কেন্দ্রীয় খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ মন্ত্রকের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে শিল্প গড়ে তোলার জন্য নানা রকম উত্সাহমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। চালু হয়েছে নানা ধরনের প্রকল্পও। আকর্ষনীয় ও বিজ্ঞানসম্মত মোড়কে নীরার বিপণন শুরু করার কাজে কেউ আগ্রহী হলে সাফল্যের নতুন দিগন্ত খুলে যেতে পারে। বাঁধা-ধরা পথের ভাবনা-চিন্তার বাইরে বেরিয়ে নীরা-কে সঙ্গী করলে সমৃদ্ধি ও সম্ভাবনা দুই-ই মিলতে পারে। শুধু চাই ইচ্ছাশক্তি, আন্তরিকতা আর নিষ্ঠা।
(সংবাদসূত্র – আকাশবাণী কলকাতার সংবাদ বিভাগ)