গোমতীর সবুজ জল কেটে তরতর করে এগিয়ে চলেছে একটা ডিঙি নৌকো। রাতের অন্ধকারকে গাঢ়তর করে গোমতীর দুপারে গহন জঙ্গলে ঢাকা অনুচ্চ পর্বতশ্রেণী আড়াল করছে ডিঙিটাকে। কৃষ্ণপক্ষের আকাশে তারাগুলো অতন্দ্র প্রহরী। ডিঙি নৌকোটি হঠাৎ অভিমুখ ঘুরিয়ে ঢুকলো ডানদিকের সরু একটা খাঁড়িতে। দুদিকে হেলদোলহীন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঘন গাছগাছালিতে মোড়া পাথরের প্রাচীর। সামনেই পথ আটকিয়ে অঝোর ধারায় নেমে আসছে পাহাড়ি জলধারা। এবার নৌকো থেকে নামলেন রাজা অমর মানিক্য। সঙ্গে আরও দুজন। পিঠে তাদের হরিণের চামড়ার তৈরী মুখবন্ধ ভারী প্রমাণ আয়তনের ছালা। ঝোরার পাশ দিয়ে খাঁড়া ভিজে পাথুরে পাহাড়টাকে সরীসৃপের মতো বেয়ে উঠে গেল ওরা আরো উঁচুতে, কোমর সমান জল ঠেলে একটু খোঁজাখুঁজি করতেই পেয়ে গেল আকাঙ্খিত গুহামুখটি। গুহার ভেতরে আরো দুটো প্রবেশপথ। বাঁদিকের পথটাই বেছে নিল ওরা। কিছু পরে শূণ্যহাতে বেরিয়ে এল। ডিঙি নৌকো আবার গোমতীর বুক ধরে এগিয়ে চলল অমরপুরের দিকে। আরাকান অর্থাৎ মগদের কাছে যুদ্ধে হেরে গিয়েছিলেন রাজা অমরমানিক্য। সেটা ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দ। নদীপথে উদয়পুর থেকে অমরপুর হয়ে রাজা অমরমানিক্য হাতির পিঠে চেপে পালিয়েছিলেন ত্রিপুরার উত্তর দিকে মনু নদীর তীরে তেতৈয়া গ্রামে। কথিত আছে, যাবার পথে অরণ্যঘেরা পাহাড়ি গুহায় লুকিয়ে রেখে গিয়েছিলেন রাজসম্পদ। রাজা অমর মানিক্য উদয়পুরে আর ফিরে আসতে পারেন নি। কুকি উপজাতিদের বিদ্রোহ আর পারিবারিক বিবাদে পর্যুদস্ত রাজা বিষপান করে আত্মহত্যা করেন। ১৫৮৬ তে উদয়পুরে আবার রাজধানী ফিরিয়ে আনেন অমরমানিক্যের পুত্র রাজধরমানিক্য। কিন্তু গুহার ভেতরে লুকিয়ে রাখা রাজসম্পদ কোনভাবেই উদ্ধার করতে পারলেন না।

এরপর কেটে গেছে পাঁচশো বছরের ও বেশী সময়। ইতিহাসের চাকা গড়িয়ে ত্রিপুরা এখন স্বাধীন ভারতের পূর্ণরাজ্য।তবুও এখনো অধরা রাজা অমরমানিক্যের গুপ্ত রাজসম্পদ।তাই গুপ্তধনের খোঁজে নাকি অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় আজও এইপথে আনাগোনা আমার মতো হুজুগে বাউন্ডুলেদের। মহারানী ঘাট থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকোয় পাড়ি দিলাম গুপ্তধনের সন্ধানে। সবুজ পাহাড়ের ছায়া মেখে গোমতী উপজাতি কন্যার কুঞ্চিত কেশের মতই এঁকেবেঁকে পাড়ি জমিয়েছে মেঘনার বুকে। দুপাশের গ্রামগুলোতে উপজাতি জীবনের বহমান ছবি — ত্রিপুরী যুবকের ব্যস্ত পদচারনা, জামাতিয়া রমণীর নদীস্নান, কচিকাঁচাদের জলকেলি। গোমতীর সবুজ জল তখন সূর্য গলা সোনালী রঙে সাজসজ্জা করা সুন্দরী চাকমা তরুণী। বাঁদিকে ডাকমুড়া গ্রামে মানিক্য রাজাদের আমলের ডাক অফিসে একসময়ে ছিল চিঠির বোঝা পিঠে নিয়ে রানার এর আনাগোনা। সর্পিল মোচড়ে গোমতীর জল যত গড়িয়েছে গ্রাম গেছে মুছে, নিবিড় হয়েছে বনভূমি। বাঁশ,বেত, রবার,সেগুন,জলপাই এর গাছগুলো আকাশ ছোঁয়ার প্রতিযোগিতায় শামিল। অশ্বত্থ গাছগুলো রূপসী গোমতীকে আলিঙ্গন করছে শাখাপ্রশাখার চুম্বনে। মাঝেমাঝেই অজস্র কলাগাছের শ্রেণীবদ্ধ উপস্থিতি। প্রকৃতির উজাড় করে দেওয়া লাবণ্যধনে গোমতী এখানে প্রাচ্যের আমাজন। শাখামৃগদের অবাধ বিচরণ,মাছরাঙাদের নীলাভ আনাগোনা, নাম না জানা পাখিদের নিরবিচ্ছিন্ন উপস্থিতিতে গোমতী মোহময়ী। জঙ্গলে মাঝে মধ্যে একটা দুটো চালাঘর শখের মাছমারাদের রাত্রিবাসের খবর জানায়। নদীর জলে ভেসে আসছে গোছা কাঁচা বাঁশ – উপজাতি মানুষদের রুজির অন্যতম অবলম্বন।

লাস্যময়ী গোমতীর কোঁচকানো চুলের একটা খাঁজ পার হয়ে বাঁদিকে ঘুরতেই পথ আটকে দাঁড়ালেন জামাতিয়া দেবী চাক্রাকমা। জঙ্গলের মধ্যে পাহাড়ের গায়ে ৯০ ফুট উচ্চতার বেলেপাথরে খোদাই করা দেবী মূর্তিটি হিন্দুদের দেবী দুর্গা আর বৌদ্ধদের দেবী তারা। বাংলার রাজা বল্লাল সেনের সময় সমতট অঞ্চলে নাথ যোগিদের ওপর আক্রমণ হওয়ায় তারা পালিয়ে আশ্রয় নেয় গোমতীর তীরে এই অরণ্যে। মহিষমর্দিনী মূর্তিসহ আরো অন্যান্য দেবদেবীর ভাস্কর্যগুলোর স্থপতি সম্ভবতঃ তারাই। পাহাড়ের গায়ে দেবতাদের এত ভাস্কর্যের জন্য ছবিমুড়ার আর এক নাম দেবতামুড়া। জামাতিয়া উপকথায় ,মগদের আক্রমণে নাকাল বুরবুরিয়ার রাজা চিচিংফা তাঁর সম্পত্তি লুকিয়ে রাখেন ঘন অরণ্যে ঢাকা এই পাহাড়ের কোনো এক গুহায়। মৃত্যুর আগে কন্যা আর জামাতাকে দিয়ে যান সেই গুহাতে পৌঁছানোর নক্সা। ছিল একটাই সাবধান বাণী – সূর্যের আলো নেভার আগেই ফিরে আসতে হবে ঐ গুহা থেকে, না হলে পড়তে হবে গুহার প্রহরিণী দেবী চাক্রাকমার রোষে।

সামনের জল কেটে নৌকো ভিড়ল শীর্ণ অথচ খরস্রোতা এক জলধারার সামনে। রাজা অমরমানিক্যের ডিঙি পাঁচশ বছর আগে যে খাঁড়ির পথ ধরেছিল তা পার হতে হল নগ্ন পায়ে। দুদিকের খাড়া পাহাড়ের ভিজে বেলে মাটির পিচ্ছিল পথ কোথাও কোথাও পাথরের গায়ে বিলীন হয়ে গতি রোধ করে। পাথরের গায়ে পা রাখার খাঁজের ভাজ প্রকৃতি তৈরী করে রেখেছে নিপুণ হাতে। তাই এগিয়ে যেতে বাধা নেই। প্রয়োজনে হাঁটু পর্যন্ত ভিজিয়ে চলার পথ খুঁজে নিতেই হয়। সামনে প্রাচীরসম সবুজ পাহাড়ের উপরিভাগ থেকে সশব্দে গড়িয়ে নামছে নির্ঝরিণী। চোখে তৃপ্তি, মনে অ্যাডভেঞ্চারের নেশা। সামনে কাঁচাবাঁশের মই ঝর্ণার জলের স্পর্শ বাঁচিয়ে ওপরের পাহাড় মধ্যস্থ সরু উপত্যকার নাগাল পেয়েছে। ওই উপত্যকা বেয়ে প্রবল বেগে গড়িয়ে আসছে হিমেল জলধারা। হাঁটুর ওপর পর্যন্ত ভিজিয়ে আরো এগিয়ে দেখা মিলল সেই কাঙ্খিত গুহামুখের। দেহের ভারসাম্য বজায় রাখাই দুরূহ। ঝুরঝুরে বেলেমাটির বাধা প্রতিহত করে ডানদিকের পাথুরে পাহাড় বেয়ে হাজির হলাম গুহামুখের সামনে। রোমাঞ্চ আর কৌতূহল দানা বেঁধেছে শরীরে আর মনে। প্রবেশ করলাম গুহার ভেতরে। হাত দিয়ে ছোঁয়া যাচ্ছে ভিজে স্যাঁতস্যাঁতে ছাদ। অন্ধকারে চোখ সয়ে যেতেই বেলে পাথরের অভ্রের ঝিকিমিকি। দু–পা যেতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল! এই তো দুটো সুড়ঙ্গের মুখ,পাশাপাশি! ডানদিকের প্রবেশপথ তুলনায় ছোটো বলেই কি অমরমানিক্যের গুপ্তধন রাখা আছে বাঁদিকের সুড়ঙ্গে? ইতিমধ্যে শ্বাসজনিত অসুবিধা জানিয়ে দিতে শুরু করেছে অক্সিজেনের অপ্রতুলতা।

ফিরে এলাম নৌকোয়। শীতল ঠান্ডা হাওয়া মেখে সূর্য তখন পশ্চিম পাহাড়ের কোলে চড়ে পাটে নামছে। ঝিরঝিরে উত্তুরে হাওয়া নদীর তিরতিরে স্রোতের সবুজ ক্যানভাসে সেই ছবি আঁকছে।পশ্চিমের আমাজন উপত্যকায় স্বর্ণসন্ধানীরা যেমন আজও খুঁজে পায়নি সোনারখনি তেমনি প্রাচ্যের আমাজনের অরণ্য ঘেরা পাহাড়ি গুহায় উপজাতি রাজার গুপ্তধন আজও অধরা। পৌষের শেষবেলায় দুহাত ভরে কুড়িয়ে নিলাম প্রাচীন ত্রিপুরার ইতিহাস আর কাহিনীর আকর, নিজেকে জড়িয়ে নিলাম কুমারী প্রকৃতির আদরে গোমতীর বাঁকে।