”নিরন্তর ভাঙা আর গড়া , নিজের সৃষ্টিকেই। এটাই বোধ হয় প্রকৃতির নিয়ম । বাধ সাধছিল মানুষই। তাই বোধ হয় এমন ভাবে গৃহবন্দী হতে হল। ” খাওয়ার থালাটা সিঙ্কে রাখতে রাখতে বলল ঋভু।
রাতুল হেসে উঠল,বলল,” এসব দর্শনের কথা ছাড়্ ভাই। ” সিগারেটটা লাইটার দিয়ে ধরিয়ে আয়েশ করে একটা ধোঁয়া ছাড়ল রাতুল।
ঋভু তর্কে জড়ালো না। খুব ক্লান্ত ও আজ। টানা বাহাত্তর ঘন্টা ডিউটি করে আজ হোস্টেলে ফিরেছে ।
ঋভু আর রাতুল দুজনেই ডাক্তার । কোভিড -১৯ এর দাপটে ঘরবাড়ি ছেড়ে ওরা এখন হাসপাতালের হোস্টেলে। বাড়িতে একটা ফোন করল ঋভু। মা ,বাবা আর বোন তিনজনেই বাড়িতে । লকডাউন এর বাজারে ওদের বের হওয়া বন্ধ । আর হাসপাতালে ডিউটি করছে বলে ঋভুও বাড়ি যাচ্ছে না । কবে যে বাড়ি ফিরবে, কবে যে বাবা মা আর বোনকে দেখবে জানা নেই ।
বিছানাতে গা এলিয়ে দিতে ঋভুর চোখের পাতা ভারী হয়ে এলো। কিন্তু অতি পরিশ্রমেও অনেক সময় ঘুম আসতে চায় না। ঋভু নানারকম কথা মনে পড়তে লাগলো।
ছোটবেলাতে ডাক্তার হবে এমন কোনো ভাবনা ঋভুর মনে ছিল না। বরং মাঠে বল নিয়ে দাপাদাপি করতে করতে মনে হত যদি রোনাল্ডো হতে পারে। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে সে। পড়াশোনার সহজ রাস্তা ধরেই এগোতে হচ্ছিল । মাধ্যমিকে নব্বই শতাংশ নম্বর নিয়ে এগারো ক্লাসে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছিল সে। উচ্চ মাধ্যমিকের নম্বরও এল নব্বই শতাংশ । নিয়ম মেনে জয়েন্টএ বসল সে। পেয়ে গেল ডাক্তার হবার সুযোগ । বাবা মার ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিয়ে ঋভুর ডাক্তারি পড়া। নিজের পেশাটাকে আর পাঁচটা পেশার মতোই মনে করে ঋভু। তাই নিজের নামের আগে সে ডাক্তার কথাটা লেখে না।
শেষ রাতে আইসোলেশন ওয়ার্ডে ডিউটি পড়েছিল ঋভুর। না কোনো পেশেন্টকে দেখতে যেতে হয়নি। তাই ওয়ার্ডের রিসেপসনে বসে রেজিস্টারের সঙ্গে কথা বলছিল। সকাল আটটা অবধি ডিউটি। নার্সরাই নির্দিষ্ট সময় পরে পরে ওয়ার্ডে টহল দিয়ে আসছে। একজন পেশেন্ট আছে ভেন্টিলেশনে। এছাড়া এখনো অবধি পজিটিভ রিপোর্ট নেই। রেজিস্টার হলেন দীপেনদা। কাঁচাপাকা চুল, মধ্যবয়সী। ভীষন ডিসিপ্লিনড্। তিরিশ বছর এই হাসপাতালে কাজ করছেন । তিনিই বলছিলেন যে এমন রোগের কথা তিনি আগে কখনও শোনেন নি। একথা সেকথায় রাত কেটে ভোরে হতে শুরু করেছে। প্রায় পাঁচটা বাজে। চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে ঋভুর। নার্স এসে খবর দিল, ”এমার্জেন্সি থেকে একজন পেশেন্ট এসেছে শ্বাসকষ্ট নিয়ে। আইসোলেশন ওয়ার্ডে আছে।”
একজন নার্স পি পি ই পড়তে সাহায্য করল ঋভুকে । নিজেকে যথাযথ নিরাপত্তায় ঘিরে আইসোলেশন ওয়ার্ডে ঢুকল ঋভু। পেশেন্ট একজন ভদ্রমহিলা। বয়স পঞ্চান্ন থেকে ষাটের মধ্যে । ওনাকে দেখে মায়ের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। কি করছে মা এখন? ঋভু জানে মায়ের দুচোখে ঘুম নেই যতক্ষণ না সে বাড়ি ফিরছে । অথচ ওকে ডাক্তারি পড়াতে মায়ের উৎসাহই সবচেয়ে বেশি ছিল। বলেছিল,”মানুষের জন্য কাজ করবি। জীবনে জীবন যোগ । এর থেকে আনন্দের কি আর কিছু হয়?” বাবা বলেছিল, ”মানুষকে সরাসরি উপকার করার সবচেয়ে সুন্দর আর সোজা পথ।”
– স্যর !
নার্সের ডাকে সম্বিত ফেরে ঋভুর । বুকে স্টেথো দিয়ে সোয়াব টেস্ট করার নির্দেশ দিল নার্সকে। ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে শ্বাস নিল ঋভু । কোরোনা পেশেন্টদের আইসোলেশন রুমে এয়ারকন্ডিশন চালানো নিষেধ। কারন ঘরের হাওয়া বাইরে বের হতে দেওয়া যাবে না। নির্দিষ্ট ঘরে গিয়ে নিয়মকানুন মেনে পিপিই খুলল সে। ঘেমে নেয়ে স্নান করে গেছে ঋভু। নাকের ওপরে চেপে বসা মাস্কের গভীর দাগ। হাত দিতে গিয়ে ও সামলে নিল ঋভু। নিজেকে পরিষ্কার করে জীবন্মুক্ত করল তারপর। ঘড়িতে তখন প্রায় আটটা । সকালের ব্যস্ততা পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে হাসপাতালে। ঋভুর সমস্ত কাজকর্ম যখন শেষ হল তখন ঘড়িতে সাড়ে আটটা ।
ব্যাগটা পিঠে নিতে নিতে কানে এল, ” একশ কুড়ি নম্বর বেডের বাড়িতে ফোন করে আসতে বললেন কেন দীপেনদা?”
উমাদির গলা। উনি সিনিয়ার নার্স। অ্যাভমিনিস্ট্রেশনের দায়িত্বে।
– কেন কি হয়েছে উমাদি? পেশেন্টের অবস্থা ভালো না। ভেন্টিলেশনে তো আছেই। হয়তো আর ঘন্টা তিনেক । বাড়ির লোক দেখবেন না?
চেঁচিয়ে উঠলেন উমাদি,”আপনি ভুলে গেলেন দীপেনদা? উনি কোভিড নাইটিন এর পেশেন্ট । আমরা শুধু খবর দেব। দেখতেও দেবো না। আর ….. ”
থামলেন উমাদি। মাথা নীচু করে আস্তে আস্তে বললেন, ‘বডিও দেব না ।’
চুপচাপ ধীর পায়ে বেরিয়ে গেলেন উমাদি। দীপেনদা আবার ফোন নম্বর ডায়াল করলেন। কিছুক্ষণ পরে বললেন, ”হ্যালো……”।
ঋভু ততক্ষণে বেরিয়ে এসেছে ঐ ঘর থেকে। হাসপাতালের চৌহদ্দির মধ্যেই হোস্টেল। হেঁটে মিনিট দুয়েক । কিন্তু ঐ মিনিট দুয়েক পথই আজ অনেক লম্বা লাগছে রাতুলের। শেষরাতে যখন ঐ ভদ্রমহিলাকে দেখতে গেছিলো রাতুল , তখন ১০২ নং পেশেন্টের কথা বলতে শুনেছিল নার্সদের। দু
-তিন জন নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিল। ১০২ এর পেশেন্ট কলকাতাতে ফিরেছিল ইতালি থেকে। সে শিল্পী । ছেনি -হাতুড়ি দিয়ে পাথর কুঁদে সুন্দরকে প্রতিষ্ঠা করে সে। ইতালিতে করোনা ভাইরাসের বাড়াবাড়ি হবার আগেই সে আসে। কিন্তু এয়ারপোর্টে ধরা পড়ে যে সে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে কোভিডের বীজ। তাই এয়ারপোর্ট থেকে বাড়ি না গিয়ে সোজা হাসপাতালে । মা বাবা কে ফোন করে সান্ত্বনা দিয়েছিল মেয়েটি, মাত্র তো কদিন। তারপরই সেরে উঠে সেরে বাড়ি যাবে। দেড় বছর পরে বাড়ি ফিরে সে কি কি খাবে সেরে তালিকাও মাকে দিয়ে দিয়েছিল ফোনে।
ঋভু হোস্টেলে এসে স্নান করেছে । রাতুল আড্ডা দিতে চাইছিল। ওর ইচ্ছে করল না। বোনের মুখটা বারবার ভেসে উঠছে চোখের সামনে। পাঁচ বছরের ছোট বোন আর্ট কলেজের ছাত্রী । খেয়ে উঠে ফোনটা হাতে নিয়ে টান টান হয়ে শুয়ে পড়ল বিছানাতে। ওয়ালেট থেকে বাবা-মা আর বোনের সাথে তোলা ওদের পারিবারিক ছবিটা বের করল। বাবা-মা কে মনে মনে প্রণাম করে বলল,” তোমাদের ইচ্ছে আমি পূরণ করব। ” আর বোনের ছবিটার ওপর একটা আলতো চুমু দিয়ে বলল,” মা বাবাকে দেখার দায়িত্ব তোর।”