Paramita Gharai
সেকাল
টগবগিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছি জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। দুপাশে খাড়া সবুজ পাহাড়ের গা বেয়ে আকাশ থেকে জোৎস্না চুঁইয়ে পড়ছে। আমার আর আমার সঙ্গীদের ঘোড়ার খুরের শব্দে চমকে উঠছে ঘুমন্ত বনভূমি, গাছের ডালে আতঙ্কে ডানা ঝটপট করে উঠল ঘুমভাঙা শকুনের ছানা, শিকারের সন্ধানে বের হওয়া হিংস্র শ্বাপদ মুখ ঢাকলো অশ্বত্থের আড়ালে।
আমি চিত্রাঙ্গদা।মনিপুর রাজসিংহাসনের একচ্ছত্র অধিকারিনী।
হ্যাঁ ,অধিকারিনী,নারী। কিন্তু সে তো কেবলমাত্র শরীরে। মনে আমি পুরুষ। “মনিপুর রাজের ভক্তিতে তুষ্ট হয়ে শিব বর দিয়েছিলেন যে তাঁর বংশে কেবল পুত্রই জন্মাবে ।” তাসত্ত্বেও আমার জন্ম হল রাজকূলে। আমার পোষাক হল পুরুষের, শিক্ষা করলাম রাজ্যপরিচালননীতি আর অস্ত্রবিদ্যা। ঘোমটা ঢাকা নমনীয়তা দেখলে হাসি পায় আমার। নিজেকে নৈবেদ্য করে পুরুষকে অর্ঘ্য দেবার কি আকুলতা!
আমার তরোয়ালের ঝনঝনানিতে বশে থাকে দস্যুর দল, আমার বজ্রশাসনে মনিপুর রাজ্যে বজায় থাকে শান্তি। আমি চিত্রাঙ্গদা। বাহুবলে রাজা।
বনভূমির নিস্তব্ধতা ভেঙে ছুটে চলেছি আজ এক ভিনদেশী সন্ন্যাসীকে দেখতে। পুব আকাশ লাল হতে শুরু করবে একটু পরেই।তার আগেই পৌঁছতে হবে আমায়। আর বেশী দূর নয় ।সামনের পাহাড় থেকে নেমে আসা ছোট্ট ঝর্ণাটার পাশেই যে গুহা সেখানেই সন্ন্যাসী আশ্রয় নিয়েছেন। নামলাম ঘোড়ার পিঠ থেকে। গুহায় তো নেই তিনি! পেছন দিয়ে বয়ে যাওয়া পাহাড়ী নদীর পাড়ে বসে ধ্যানমগ্ন অনিন্দিত সৌম্যকান্তি । মুখে এসে পড়েছে নতুন সূর্যের প্রথমআলো। ইনি সন্ন্যাসী!! না ,না,হতে পারে না।এ তো আমার সেই অদেখা প্রাণপুরুষ। আমার ঘুমিয়ে থাকা কিশোরী মনের অতৃপ্ত আকাঙ্খা। আমার অবদমিত নারীদেহের তপ্ত কামনা ।লুটিয়ে পড়লাম পায়ে।
“আমি তোমারে করিব নিবেদন,
আমার এই প্রাণ দেহ মন”
ছিটকে উঠলেন সন্ন্যাসী । পরিচয় দিলেন, তিনি মধ্যমপান্ডব অর্জুন। পৌরুষের অহঙ্কারের মধ্যেও ফল্গুধারার মতোই বয়ে চলছিল আমার নারীর মন , তা আজ ঝড় হয়ে নেমে এসে শুকনো ডালপালা উড়িয়ে নিয়ে গেল।
ফিরিয়ে দিলেন তিনি।
“বরণযোগ্য নহি বরাঙ্গনে
ব্রহ্মচারী ব্রতধারী”
নারীজন্মকে হেলায় তুচ্ছ করেছি এতকাল।আজ বুঝলাম আমার পৌরুষসাধনা ব্যর্থ। “মদন দেব ! শুধু একবছরের জন্য আমাকে দাও স্বর্গের সৌন্দর্য্য।” আমার রূপের আগুণে পুড়ে যাক ব্রহ্মচারী পুরুষের স্পর্ধা । পুরুষ তুমি নারীকে কামনা করবে না? তোমার যৌবনতৃষ্ণা প্রশমিত করো বীর আমার রমণে ।
কিশোরীর নরম পেলব স্পর্শে পাকে পাকে বাধা পড়েও রমণে ক্লান্তি আসে বুঝিনি আগে। সব্যসাচী শুনেছেন চিত্রাঙ্গদার কথা।
“আগ্রহ মোর অধীর অতি,
কোথা সে রমণী বীর্যবতী।
দারুন সে ,সুন্দর সে,
উদ্যত বজ্রের রুদ্ররসে,
নহে সে ভোগীর লোচনলোভা,
ক্ষত্রিয়বাহুর ভীষণশোভা।”
মদনদেব! জয় হল সত্যের। হে পুরুষ! আমি যেরকম সেরকম করেই গ্রহণ করো আমায় । “আমি চিত্রাঙ্গদা,রাজেন্দ্রনন্দিনী।” অবহেলায় পায়ের তলায় রেখো না আমায়, তোমার পুজোর অর্ঘ্যও চাইনা বীর। তোমার সকল ব্রতে পাশে থাকার সম্মতি জানিয়ে পাশে রাখো আমাকে।
একাল
শোনো পুরুষ ! আমি একালের চিত্রাঙ্গদা। আমার হাতে ধনুকের পরিবর্তে ক্ষুরধার কলম। অস্ত্রের ঝনঝনানির থেকেও আমি ভালবাসি বেহালার মূর্ছনা। রাজ্যশাসন নয়, চোখে আমার মানুষ গড়ার স্বপ্ন। দস্যুদলনী হয়েও আমি সমাজ গড়ার কারিগর। আকাশ ভাগাভাগি করে নিতে চাই না আমি, আমি চাই সমস্ত আকাশ জুড়ে পাশাপাশি একসাথে বেঁচে থাকার অধিকার। ঘামে ভেজা শরীরের নারীত্বকে বিকিয়ে নয়, ফেলে দেওয়া বাসি ফুলের অবহেলা নিয়ে নয়, জলসাঘরের বেলওয়াড়িঝাড় হয়েও নয়; পূর্ণ মনুষ্যত্ব নিয়ে আমিও সম্পূর্ণ মানুষ।
জানতে চাই তোমার কাছে – ভালবেসে তুমিও কি থাকবে আমার পাশে? আমার সকল সাজে ,সকল কাজে আমার দোসর হয়ে? আমি শুধু তোমার নর্মসহচরী নই, তুমিও আমার কর্মসহচর।
(রবি ঠাকুরের “চিত্রাঙ্গদা” গীতিনাট্য অবলম্বনে )