Gaudiya dance: The lost dance style of Bengal and Dr. Mahua Mukhopadhyay
করতোয়া নদীর ধারে পৌন্ড্ররাজ্য। সে রাজ্যের রাজার নাম জয়ন্ত। সম্পদ শালী পৌন্ড্র রাজ্যের স্কন্দমন্দিরের দেবদাসী কমলার নাচ দেখে প্রেমে পড়েছিলেন কাশ্মীরের রাজা জয়পীড়। কাশ্মীরের কবি কলহনের 'রাজতরঙ্গিনী'গ্রন্থে বিশেষ চরিত্র এই কমলা সুন্দরীর। সে গল্প যাই হোক, দেবদাসী কমলার যে নাচ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন কাশ্মীরের রাজা তা হল বর্তমানের গৌড়ীয় নৃত্য।
ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্যধারার অন্যতম দাবিদার গৌড়ীয় নৃত্য। ড. মহুয়া মুখোপাধ্যায়ের নিরলস অধ্যবসায় ও প্রচেষ্টার ফলে পুণর্নিমিত হয়েছে গৌড়ীয় নৃত্য। তিনিই বলছিলেন রাজা জয়পীড় ও দেবদাসী কমলার উপাখ্যান যা প্রমাণ করে প্রাচীন বাংলার নিজস্ব শাস্ত্রীয় নৃত্যশৈলীর কথা। যদিও গৌড়ীয় নৃত্য নামকরণ হয় ১৯৯৪ সালে , তবুও এই নির্মাণ কাজের ভিত তৈরী হয়েছিল ১৯৭০ সালে।
ছোট মহুয়া বাবার সাথে বেড়াতে গিয়েছিলেন বাঁশবেড়িয়ার হংসেশ্বরী মন্দিরে। পাশেই রয়েছে অনন্ত বাসুদেবের মন্দির। টেরাকোটার এই মন্দির দুটোর গায়ে অসংখ্য নাচগানের ভাস্কর্য। ড. মহুয়া মুখোপাধ্যায়ের ভাষায়,' নাচ বলতে তখন আমি বুঝি রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গে নাচ আর ভরতনট্টম। কলকাতা শহর তখনও ছৌ , ঝুমুর বা অন্যান্য লোকনৃত্যকে সমাদর করতে শেখেনি। আর ছিল উদয়শঙ্করের বিশেষ নাচ। ' কিন্তু মন্দিরের ভাস্কর্যের সঙ্গে সেসব নাচের কোনো সাদৃশ্য খুঁজে পায়নি তাঁর শিশুমন। কেবল মনে হয়েছিল, 'এটা কিরকম নাচ? বাংলার নাচ?' কিন্তু বাংলার এমন নাচের কথা কখনও তো শোনেননি!
পড়াশোনার পাশাপাশি এই প্রশ্ন ড. মুখোপাধ্যায়কে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে সেই সময় থেকেই। কিশোরী মন যত পরিণত হয়েছে তত খোঁজ করেছেন যুক্তিসঙ্গত উত্তরের। বিজ্ঞানের অধ্যাপিকা হয়েও পড়াশোনা করেছেন ভারতের প্রাচীন শাস্ত্র থেকে মঙ্গলকাব্যের খুঁটিনাটি। ঘুরে বেড়িয়েছেন রাঢ় বাংলা, বিহার , ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড সহ নানা জেলার আনাচে কানাচে। শিখেছেন ছৌ, ঝুমুর ,নাচনী, গম্ভীরা,রায়বেশেসহ বাংলার বিভিন্ন লোকনৃত্য। ঘুরে বেড়িয়েছেন নানা জাদুঘর। নিরীক্ষা করেছেন বাংলার স্থাপত্য, শিলাফলক, মন্দিরের গায়ে উৎকীর্ণ প্রাচীন ভাস্কর্য। শিখেছেন সংস্কৃত ।
যখনই যেখানে গিয়েছেন , কাজেই হোক অথবা বেড়াতে, ধর্ণা দিয়েছেন সেখানকার জাদুঘরে যদি এককণা ইতিহাস খুঁজে পান!
অধ্যাপিকার ভাষায়, ভরতমুনির নাট্টশাস্ত্রে উল্লেখিত রয়েছে চারটি প্রাদেশিক নৃত্যচর্চার কথা। ভারতের চার অঞ্চলের নৃত্যধারা হল্ অবন্তী,পাঞ্চাল , দাক্ষিনাত্য, ঔড্রমাগধী। ঔড্রমাগধী অর্থাৎ বর্তমান ভারতের পশ্চিমবাংলা, বিহার উড়িষ্যা , ঝাড়খণ্ড ও বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকার বিভিন্ন মন্দিরের গায়ে উৎকীর্ণ আছে সে নাচের ভঙ্গীমা। তাঁর মতে, বাংলার বর্ধিষ্ণু সমাজে নাচ ,গান ও বাদ্যযন্ত্রের বহুল চর্চা হত। তাঁর মতে, যেকোন শাস্ত্রীয় নৃত্যশৈলীর স্তম্ভগুলো হল - সাহিত্য ও ইতিহাস, সঙ্গীত শাস্ত্র , স্থাপত্য , ভাস্কর্য চিত্রশিল্প লেখমাল এবং গুরু পরম্পরা লোকায়ত নৃত্যধারা।
যেরকমভাবে পুরাণ ও ভাস্কর্যের সাথে লোকনৃত্যের সমন্বয়ে যেমন পুণর্গঠন হয়েছিল ভরতনট্টম ও ওড়িশী নাচের যথাক্রমে গুরু রুক্মিনী অরুন্ডেল ও গুরু সংযুক্তা পাণিগ্রাহীর হাত ধরে , তেমনি বাংলার চলমান সংস্কৃতির ধারাকে একমালায় গাঁথতে নিজের অজান্তেই সেপথেই হেঁটেছেন অধ্যাপিকা ডঃ মহুয়া মুখোপাধ্যায়। ভাস্কর্যের সঙ্গে মিলিয়েছেন কাব্য , শাস্ত্র , গান যার কিছু উৎকীর্ণ হয়েছে খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে অথবা চতুর্থ শতক থেকে খ্রীষ্টীয় অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত।
প্রচুর পরিশ্রম, গবেষণা ও অধ্যাবসায়ে বাংলার ধ্রুপদী নৃত্যেকে পুণর্গঠন করেছেন তিনি। সহায়তা পেয়েছেন ডঃ পল্লব সেনগুপ্ত, মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, ব্রতীন মুখোপাধ্যায়, নরোত্তম সান্যাল, গম্ভীর সিং মুড়া সহ বহু গুণীজনের।
বাংলার নিজস্ব ধ্রুপদী নৃত্যশৈলীর দাবি জানিয়ে গবেষক মহুয়া মুখোপাধ্যায় প্রথম বক্তব্য রেখেছিলেন পদ্মভূষণ উপাধিপ্রাপ্ত বিখ্যাত ভারতনট্টম শিল্পী শ্রীমতী কলানিধি নারায়ণম আয়োজিত একটি সেমিনারে, ১৯৯৩ সালে , মাদ্রাজে। তখন নামকরণ না হলেও বাংলার নিজস্ব নৃত্যশৈলীর পুণর্নিমিতি নিয়ে সেখানে বাংলার ধ্রুপদী নাচের প্রামাণ্য তথ্য উপস্থাপন করেছিলেন। সবটাই তাঁর নিজের গবেষণালব্ধ। উপস্থিত গুণীজন স্বাগত জানালেন তাঁর সাধনাকে। পরের বছর আমন্ত্রণ পেলেন চিদম্বরম নৃত্যোৎসব।
১৯৯৪ সালে আমন্ত্রণ পেলেন পশ্চিমবঙ্গ স্কুল অফ্ কালচারাল স্টাডিজ্এ বক্তৃতা দেবার সুযোগ হল। এই উপলক্ষ্যেই নৃত্যশৈলীর নামকরণ হল গৌড়ীয় নৃত্য। এল কাঙ্খিত স্বীকৃতি।
উল্লেখ্য, সঙ্গীত নাট্য আকাদেমির গৌড়ীয় নাচের কৌলিন্য মেনে নিয়ে কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক মন্ত্রক থেকে ১৯৯৬ সাল থেকে ছাত্রছাত্রীদের জন্য স্কলারশিপ চালু করেছে। ১৯৯৭ সালের ব্রহ্মানন্দ কেশব চন্দ্র কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগ থেকে ডঃ মহুয়া মুখোপাধ্যায় রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃত্য বিভাগে যোগ দেন। বর্তমানে তিনি ঐ বিভাগের প্রধান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহামা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং প্রফেসরের সম্মানও তাঁর ঝুলিতে।
আশির দশক থেকে ড. মহুয়া মুখোপাধ্যায় ও শ্রী অমিতাভ মুখোপাধ্যায়ের সাধনা আজও অব্যহত। ড. মুখোপাধ্যায়ের কাজ নিয়ে তৈরী হয়েছে অনেক স্বল্প দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র। যেমন - ডান্স অফ গড’ (১৯৯৭), ভারত সরকারের ফিল্ম বিভাগ দ্বারা নির্মিত ‘গীতময় তন্ময় – ট্রান্স ইন মোশন’ (২০১২), রেজারেকশন (রাজ্যসভা টিভি চ্যানেল ২০১৩), গৌড়ীয় নৃত্য – গোল্ডেন গ্লোরি : এ ক্লাসিকাল ডান্স অফ বেঙ্গল (সঙ্গীত নাটক আকাদেমি ২০১৭) ইত্যাদি। তাঁর লেখা প্রায় কুড়িটি বই এবং ১৮০টিরও বেশি নিবন্ধ রয়েছে।। ড. মহুয়া মুখোপাধ্যায়ের নৃত্য প্রতিষ্ঠান ‘গৌড়ীয় নৃত্যভারতী’র । ‘
তাঁর কাছে তালিমপ্রাপ্ত পঞ্চাশেরও বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী ভারত সরকারের জুনিয়র এবং সিনিয়র স্কলারশিপ ও ফেলোশিপ পেয়েছেন।
নাইজেরিয়ান কবি তানুর ওজাইডে তাঁর কবিতার বই 'দ্য বিউটি আই হ্যাভ সিন্: অ্যা ট্রিলজি'তে মহুয়া মুখোপাধ্যায়কে ও তাঁর নাচকে বর্ণনা করেছেন 'প্রাইড অফ্ বেঙ্গল কবিতা'য়। এখন দেশে বিদেশে তাঁর অনেক ছাত্রছাত্রী। গৌড়ীয় নৃত্যগুরু মহুয়া মুখোপাধ্যায়ের সাধনা তাদের হাত ধরে বাংলার সংস্কৃতির ধ্বজা বহন করে চলবে সুদূর ভবিষ্যতে।
তথ্যসূত্র: ডঃ মহুয়া মুখোপাধ্যায়, (গৌড়ীয় নৃত্যের পুণর্নিমাতা) , অবসরপ্রাপ্ত নৃত্যবিভাগের অধ্যাপিকা ,রবীন্দ্রভারতী।