Pro-MASS Feature
।। জয়দীপ চক্রবর্তী ।।
প্লাসটিক – শব্দটা শুনলেই মনের কোণে ভেসে ওঠে পাড়ার ড্রেনে দলা পাকানো হাজারো ক্যারিব্যাগের ছবি। স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিকভাবে প্লাসটিকের ক্যারিব্যাগগুলি মাটির সাথে মিশে যায় না অর্থাৎ এগুলি বায়ো-ডিগ্রেডেবল নয়। সেজন্যই প্লাসটিক নিয়ে জনমানসে নানা প্রশ্ন। অথচ হালকা এবং সস্তা হওয়ায় প্লাসটিক পণ্য সকলের পছন্দ। কাজেই অনেকদিন আগে থেকেই শুরু হয়েছে প্লাসটিক পণ্যকে পরিবেশ বান্ধব পণ্যে রূপান্তরিত করার প্রয়াস। সাফল্যও পাওয়া গেছে। প্লাসটিক বায়ো-ডিগ্রেডেবল না হলেও, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগলবন্দীতে প্লাসটিক পণ্যকে আজকাল পুনর্ব্যবহারযোগ্য করা সম্ভব হয়েছে। ফলে এখন আর পরিবেশ বান্ধব নয় বলে প্লাসটিক পণ্যকে দূরে ঠেলে দেওয়া যাবে না।

“বর্তমান সময়ে পরিবেশের স্বাস্থ্য রক্ষার ব্যবস্থা করে প্লাসটিকের ব্যবহার দ্রুত বেড়ে চলেছে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সৌজন্যে প্লাসটিক শিল্পক্ষেত্রে কাজের সুযোগ বেড়েছে এবং প্লাসটিক শিল্পকে ঘিরে নতুন করে স্বপ্ন দেখছে দেশের তরুন সমাজ”, এই কথাগুলি বললেন হায়দ্রাবাদের চেরলাপল্লি স্থিত সেন্টাল ইনস্টিটিউট অব প্লাসটিক্স এঞ্জিনিয়ারিং এবং টেকনোলজি (সিপেট)-এর চিফ ম্যানেজার (প্রজেক্ট) শ্রী ভি কিরণ কুমার । এখানে বলে রাখা ভাল, সিপেট হলো প্লাসটিক এবং সংশ্লিষ্ট শিল্পক্ষেত্রে মানব সম্পদের প্রশিক্ষণ এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদানে দেশের অন্যতম মুখ্য সংস্থা। কেন্দ্রীয় রাসায়নিক ও সার মন্ত্রকের অধীনে ১৯৬৮ সালে চেন্নাই-তে সিপেট স্থাপিত হয়। কালক্রমে সিপেট ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের গুয়াহাটি, ইম্ফল ছাড়াও হায়দ্রাবাদ, আমেদাবাদ, অমৃতসর, ঔরঙ্গাবাদ, ভোপাল, ভুবনেশ্বর, হাজিপুর, হলদিয়া, জয়পুর, লক্ষ্মৌ, মাইশোর এবং পানিপথে সিপেট-এর সেন্টার আছে। শ্রী কিরণ কুমার জানালেন, সিপেটের অধিনে একটি বৃত্তিমূলক কেন্দ্র আগামীদিনে আগরতলায় গড়ে তোলার জন্য পরিকল্পনা রয়েছে।
প্লাসটিক শিল্পক্ষেত্রের দ্রুত বিকাশের সাথে পাল্লা দিতে বেড়েছে দক্ষ কর্মীর চাহিদা। প্লাসটিক শিল্পের প্রযুক্তি সংক্রান্ত গবেষণার কর্মযজ্ঞে সিপেট ইতিমধ্যেই সারা বিশ্বে প্রথম সারির সংস্থা হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। গবেষণামূলক কাজের পাশাপাশি সিপেট গুরুত্ব দিয়েছে প্রশিক্ষণের উপর। “শিল্পক্ষেত্রের চাহিদা অনুযায়ী প্রশিক্ষণের জন্য কোর্স তৈরি করেছে সিপেট। ফলে কোর্স শেষ করার পর শিক্ষার্থীদের প্রায় ৯০% চাকরি পেয়ে যায়। অনেকে আবার নিজেরাই শিল্প কারখানা খুলে ব্যবসা শুরু করে”, জানালেন কিরণ কুমার। সিপেট-এর কোর্সগুলি এআইসিটিই দ্বারা অনুমোদিত এবং ভারত সরকারের শিক্ষা মন্ত্রকের দ্বারা স্বীকৃত। প্লাসটিক শিল্পের জন্য কাঁচামাল প্রক্রিয়াকরণ থেকে শুরু করে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এবং সফটওয়ার ব্যবহার করে পণ্যের ডিজাইন করা এবং সেই ডিজাইন অনুযায়ী পণ্য তৈরির যাবতীয় কৌশল হাতে-কলমে শিক্ষা দেওয়া হয় সিপেট-এ। প্রতিটি বিভাগের জন্য উন্নত মানের আলাদা পরিকাঠামোতে শিক্ষার্থীরা পেশাদার ও দক্ষ প্লাসটিক শিল্প হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। সিপেট-এ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং সদ্য চাকরি পাওয়া গায়ত্রী সাধারণ পরিবারের গ্রামের মেয়ে। কিন্তু সিপেট-এ আসার পর গ্রাম্য জড়তা কেটে গেছে। চোখে-মুখে এখন আত্মবিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি। লম্বা বিনুনি দুলিয়ে গায়ত্রী জানালেন, “সিপেট-এর প্রশিক্ষণের পরিকাঠামো এমনই যে, এখানে বিদ্যা-বুদ্ধি-আত্মবিশ্বাস – সব কিছুরই বিকাশ হয়। আমার মতো অনেক গ্রাম্য মেয়ের জীবনে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে প্লাসটিক শিল্প”।
কথায় কথায় কিরন কুমার জানান, শুধু ভারতবর্ষেই নয়, সিপেটে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ কর্মীর চাহিদা ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়ায় বেড়ে চলছে। ডিপ্লোমা কোর্স এবং পোষ্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা কোর্সগুলিতে জয়েন্ট এন্ট্রান্স-এর মাধ্যমে ভর্তি হওয়া যায়।
নিয়মিত কোর্সের পাশাপাশি স্বল্প সময়ের জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণমূলক ও প্রযুক্তি বিষয়ক সেমিনার এবং দক্ষতা বিকাশের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও রয়েছে। এরমধ্যে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ক্যাড-ক্যাম প্রশিক্ষণ পরিকাঠামো এবং পঠন-পাঠন সহজেই নজরকাড়ে। সিপেট-এর ক্যাড-ক্যাম বিভাগের স্মার্ট ও আত্মপ্রত্যয়ী সঈদ মোক্তার-এর বয়স ৩০-র নিচে। কিন্তু দেশের সুরক্ষা ব্যবস্থায় ব্যবহৃত প্লাসটিকের বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনের জন্য ক্যাড-ক্যাম ও অন্য আধুনিক সফটওয়ার ব্যবহার করে ছাঁচ বা মোল্ডের ডিজাইন তৈরিতে ইতিমধ্যেই যথেষ্ঠ অভিজ্ঞ। মোক্তারের কথায়, “সিপেট-এর দক্ষতা বাড়ানোর প্রোগ্রামগুলি নিত্যপরিবর্তনশীল সিশ্ব বাজারের চাহিদার সাথে সাযুজ্য রেখে তৈরি করা হয় এবং এটাই সিপেট ট্রেনিং-এর প্লাস পয়েন্ট”। এই ধরণের স্বল্প মেয়াদি কোর্সগুলি সাধারণত: সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রক কিংবা শিল্পসংস্থা স্পনসর করে। প্রতিটি কোর্স-এ তফশীলি জাতি-উপজাতি ও পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের জন্য বিশেষ সুবিধা রয়েছে।
প্লাসটিক শিল্পের ভবিষ্যৎ কেমন জিজ্ঞাসা করায় সিপেট-এর প্লাসটিক মোল্ড ডিজাইন-এ পোষ্ট ডিপ্লোমা কোর্সের ছাত্রী সন্তোষী কুমারি বেশ আত্মপ্রত্যয়ের সাথে জানালেন, এখন তো প্লাসটিক যুগ চলছে। মুঠো ফোন, হাল আমলের ট্যাব কিংবা ল্যাপটপ – সবেতেই তো প্লাসটিকের উপস্থিতি। টুথব্রাশ, হাত ঘড়ি, চশমার মতো নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্রেও আজ প্লাসটিকের ব্যবহার হচ্ছে। প্লাসটিকের তৈরি চেয়ার টেবিল, টিভি ইত্যাদি তো আজকাল অত্যন্ত কমন ব্যাপার। গাড়ি, বাড়ি – কোথায় প্লাসটিক নেই? জলের পাইপ, গ্যাসের পাইপ, এরোপ্লেনের বহিরঙ্গে কিংবা ভিতরের ডিজাইনেও রয়েছে সেই প্লাসটিক। ডিফেন্সের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সাজসরঞ্জাম ও অস্ত্রশস্ত্র নির্মানে প্লাসটিক ব্যবহার করা হয়।
সত্যিই তো, প্লাসটিক ছাড়া বর্তমান সভ্যতাকে চিন্তা করা অসম্ভব। প্লাসটিকের ক্রমবর্ধমান ব্যবহার এবং পরিবেশের উপর কুপ্রভাবের প্রসঙ্গ টেনে এনে শ্রী কিরণ কুমার বললেন, প্লাসটিক বর্জ্যকে রি-সাইকেল বা পুনর্ব্যবহারযোগ্য করার প্রযুক্তি ব্যবহার করে শক্তি উৎপাদনও করা সম্ভব হয়েছে। কাজেই বায়ো-ডিগ্রেডেবল না হলেও, প্লাসটিক বর্জ্য সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনার বিষয়টিকে যথাযথভাবে কার্যকরী ও রূপায়িত করলে পরিবেশের সুস্থিতি যেমনি বজায় থাকবে, তেমনি সহজে মানব সমাজের নানা প্রয়োজন মেটানোও সম্ভব হবে। একই সাথে তিনি এও বলেন যে, প্লাসটিক বর্জ্য যেখানে সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে না ফেলে যথোপযুক্তভাবে সেগুলি পুনর্ব্যবহারের জন্য জড়ো করতে অবশ্যই জনসচেতনতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সন্তোষী, গায়ত্রী কিংবা মোক্তারের ভাষায়, প্লাসটিক শিল্প একদিকে কাজের সুযোগ তৈরি করছে, অন্যদিকে প্লাসটিক বর্জ্যকে পুন:ব্যবহার করে ছোট ছোট অনুসারি শিল্পের জন্ম হচ্ছে। সিপেট-এর কর্মযজ্ঞ দেখে মনে হয়, ডিজিট্যাল ইন্ডিয়া এবং মেক-ইন ইন্ডিয়ার উড্ডীয়মান পতাকায় দেশের প্লাসটিক শিল্প এক নতুন রঙিন আভা এবং এর অনেকটা কৃতিত্ব দাবি করতে পারে বিভিন্ন রাজ্যে গড়ে ওঠা সিপেট সেন্টারগুলি।
- জয়দীপ চক্রবর্ত্তী pro-mass.com এর সম্পাদক