প্রনবেন্দু সেনগুপ্ত: Sep 12, 2016: দক্ষিণ ত্রিপুরার বিলোনিয়া মহকুমার রাজনগরের বিভিন্ন গ্রামে একসময় ছিল ‘গব’ বা ইন্ডিয়ান বাইসনের দিন দুপুরে উৎপাত, অবশ্যি খাওয়ার সন্ধানে| লোকেরাও ভয়ে অতিষ্ঠ হয়ে সুযোগ মতো পেলেই বাইসন মেরেছে| বাইসনের সংখ্যাও মাত্রাত্রিতিরক্ত ভাবে কমতে কমতে হাতে গোনা দুই অঙ্কের (৪৬) মধ্যে নেমে এসেছিল| অন্তত এক-দশক আগের এই চিত্র আজ আবার দারুন ভাবে পাল্টেছে| কয়েক বছর হলো, এখন গড়ে উঠেছে বাইসন পার্ক| ঠিকানা তৃষ্ণা অভয়ারণ্য| সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুসারে, তৃষ্ণা অভয়ারন্যে বর্তমানে বাইসনের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১৬০|

বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ত্রিপুরার বিলোনিয়া-সোনামুড়ার জঙ্গল পথ গিয়ে মিশেছে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলের সাথে| ওই বনানী ধরে বসবাস ও ঘুরে বেড়ানোর অভ্যাস ছিল গবদের। কিন্তু, সীমান্তপথে কাঁটাতারের বের দেওয়ার ফলে, বন্য প্রানীদের অবাধ যাতায়াত রুদ্ধ হয়| তেমনি, সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে অবাধে গাছ কেটে ফেলে জঙ্গল পরিস্কার করে নেওয়ার ফলে একসময় গোবর খাওয়ার খোঁজে বসতিগুলোতে আসা যাওয়া শুরু করে |
২০০৫-২০০৬ সালে ত্রিপুরা সরকারের তরফ থেকে বন দপ্তর এবং ঐ এলাকার বিভিন্ন পঞ্চায়েত সংস্থাগুলো মিলে গ্রামবাসীদের মধ্যে বাইসন সমন্ধে বোঝাতে শুরু করে| বাইসন হত্যা বন্ধ করতে জনমত গড়ে তোলার সভা শুরু হয়| ধীরে ধীরে গ্রামের অধিবাসীরা উপলব্ধি আসতে শুরু করে যে, বাইসন একটি বিরল প্রাণী, একে রক্ষা করতেই হবে |
নাগরিকদের জানানো হয়, এক-একটি বাইসন থেকে পাওয়া যায় ১৪০০ থেকে ১৬০০ কিলোগ্রাম মাংস, এরা ঘন্টায় ৬০ কিলোমিটার দৌড়াতে পারে| বন দপ্তর সেখানকার অনেকগুলি এলাকা উন্নত করে বাইসনের থাকার উপযুক্ত করে নেয়| গড়ে তোলে বাইসন ন্যাশনাল পার্ক| এই সংরক্ষিত এলাকাতে তখন থেকে আর লোকজনের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়|
উল্লেখ্য, ১৯৮৭ সালে তৃষ্ণা অভয়ারন্য গড়ে উঠেছিল মোট ১৮৯ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে, পরে এর থেকে ০.৩০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে গড়ে উঠে বাইসন পার্ক হয়েছে| বাইসনের সংরক্ষণের জন্য তৃষ্ণা অভয়ারন্যের মধ্যে ৫২-টি জলাশয় গড়ে তুলেছে বন দপ্তর| এই জলাশয়গুলিতে প্রতিদিন বিকালে বাইসনগুলি জল খেতে আসে| জলের মধ্যে এক ধরনের লবন মিশিয়ে দেওয়া হয় যা খেয়ে বাইসনগুলি সুস্থ থাকে|
স্থানীয় বিধায়ক সুদন দাস জানান, এই অভয়ারন্যের মধ্যে যাদের জোত জমি ছিল তাদেরকে সরকারের তরফ থেকে ক্ষতিপূরণ দিয়ে জমি কেনা নেওয়া হয়েছে এবং যাদের দখলদারিতে জমি ছিল তাদেরকে অভয়ারন্যের ভেতর থেকে উঠিয়ে বাইরে অন্য জায়গায় পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছে| কয়েকটি পরিবার এখন আছে রাধানগর এলাকাতে, তাদেরকেও পুনর্বাসন দেওয়ার জন্য সরকারী তরফে ব্যবস্থা করা হচ্ছে|
তৃষ্ণা অভয়ারন্য-র মধ্যে ইকো ডেভেলপমেন্ট কমিটি করে দেওয়া হয়েছে| এবং তাদের বলা হয় যে এই সংরক্ষিত বনাঞ্চলের যাতে কোনরকম ক্ষতি না করে জলাশয়গুলিতে মাছ চাষ করে তাদের অর্থনৈতিক উন্নতির কাজ করতে পারে| বাইসনগুলি গতিবিধি কিছু কিছু নির্দিষ্ট এলাকাতে সীমাবদ্ধ রাখতে, তাদের খাবারের জন্যে ঘাস লাগানো হয়েছে| বিকেল বেলা প্রত্যেক দিনে বাইসনগুলি জলাশয়গুলিতে আসে জল খেতে, তখনই কেবল পর্যটকরা তাদের দেখতে পায়| পর্যটকদের জন্যে এই অভয়ারন্যের মধ্যে ৮টি টাওয়ার নির্মান করা হয়েছে যেগুলির একেকটির উচ্চতা ৫২ ফুট| বাইসনগুলি আগে এই অভয়ারন্য থেকে বের হয়ে বাংলাদেশে চলে যেত| এখন তারকাটার বেড়া নির্মাণ হওয়ার ফলে আর সেদেশের জঙ্গলে যেতে পারছে না |
এক নিরীহ বিরল প্রাণীর ঠিকানা এখন ত্রিপুরার তৃষ্ণা অভয়ারণ্য| তারই আকর্ষণে বাড়ছে রাজ্য ও বহিরাজ্যের পর্যটকদের আগমন|