October 10,2017 : ।। নীতা সরকার।।
চোখে মুখে এক রাশ বিষ্ময়। নিজেদের চোখকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। অথচ তাদের চোখের সামনেই যেন দেখতে দেখতে পাল্টে গেল নিজের গ্রামটা। স্মৃতি হাতড়ে কিছুতেই যেন অতীতের পশ্চিম নোয়াবাদীর সাথে হাল আমলের পশ্চিম নোয়াবাদীকে মেলাতে পারছেন না্। এই অনুভূতি পুরাতন আগরতলা ব্লকের পশ্চিম নোয়াবাদী পঞ্চায়েতের অনাথ বন্ধু এবং কুশান সরকারেরা। সম্প্রতি পশ্চিম নোয়াবাদী পঞ্চায়েতের ‘একতারা’ কমিউনিটি হলে আয়োজিত হয় গ্রাম সংসদ। উন্নয়নমূলক কাজের হিসেব নিতে গ্রামের অন্যান্যদের সাথে অনাথ বন্ধু এবং কুশান সরকারও এসেছিলেন এই গ্রাম সংসদে।এই দুই প্রবীন ব্যক্তি আলাপচারিতায় জানালেন, আমাদের গ্রামে একসময় দু’পায়ের রাস্তা, নয়তো ধান ক্ষেতের আল বেয়ে চলাচল করতে হতো। ছিল না স্বাস্থ্য পরিসেবা, বিদুৎ ও পানীয় জলের ব্যবস্থা। রাতে কেরোসিনের কুপি বাতি আর পানীয় জলের জন্য ছড়া বা নদীর জল নয়তো পাত কুয়া। উৎপাদিত ফসল বাজারজাত করার জন্য ছিল না কোন হাট-বাজার। শিক্ষার জন্য ছিল না কোন সুব্যবস্থা। বামফ্রন্ট সরকার রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পরই ধীরে ধীরে গ্রামের উন্নয়ন শুরু হয়। সেই উন্নয়নে আমরাও দু’হাত বাড়িয়ে দিয়েছি। গ্রামের উন্নয়ন মূলক কাজকর্মের সফল বাস্তবায়নের উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি পশ্চিম নোয়াবাদী পঞ্চায়েতের এই গ্রাম সংসদ। সংসদে উপস্থিত সকলেই উন্নয়ন মূলক কাজের হিসেব যেমন বুঝে নিয়েছেন,তেমনি আরও কীভাবে গ্রামের উন্নয়ন ঘটানো যায় সে বিষয়ে ও গ্রামবাসীরা মতামত ব্যক্ত করেন। কথা প্রসঙ্গে অনাথ বন্ধু এবং কুশান সরকার আরও জানান, সংসারের অভাব অনটনে বসবাসের জন্য একটা ভালো ঘর তৈরী করতে পারেননি।অবশেষে রাজ্য সরকারের উদ্যোগে আবাসন প্রকল্পে বসবাসের জন্য পাকাঘর পেয়েছেন। সেই সাথে পেয়েছেন শৌচালয়ের ব্যবস্থাও। রাতের বেলায় ঝড় বৃষ্টি আসার শঙ্কায় আর ঘুম ভাঙ্গেনা তাঁদের। উঁকি মেরে দেখতে হয় না ঘরের ছাঁউনি বেয়ে জল আসে কিনা। মাথার উপর নতুন টিনের ছাঁউনি বার বার মনে করেয়ে দেয় এ রাজ্যের ক্ষমতায় যদি বামফ্রন্ট সরকার না থাকতো তাহলে তাদের দুরবস্থার অন্ত থাকতো না। এখানে উল্লেখ থাকে যে, চলতি অর্থবছরে গ্রামের আরও ৮টি পরিবার আবাসন প্রকল্পে বসবাসের জন্য ঘর পেয়েছেন।
রাজধানীর লাগোয়া পুরাতন আগরতলা ব্লক। ১৪টি গ্রাম পঞ্চায়েত এবং ৪টি এডিসি ভিলেজ কমিটির মধ্যে পশ্চিম নোয়াবাদী একটি। চতুর্দিকে সবুজের সমারোহ। সোনালী ধানের ক্ষেত। রয়েছে ছোট বড় পুকুর ও ছড়া। মাঝে মাঝে রয়েছে বসবাসের বাড়িঘর।মনে হয় প্রকৃতি যেন এখানে সব কিছু ঢেলে সাজিয়ে রেখেছে। ১.২৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনে ৬টি পাড়া নিয়ে গঠিত এই গ্রামে রয়েছে ৭৬২টি পরিবারের ২৮৮৭ জন গ্রামবাসীর বসবাস।
পঞ্চায়েতের প্রধান পদে রয়েছেন কোহিনূর বেগম। তিনি গ্রামের উন্নয়নমূলক কাজের তথ্য দিয়ে জানালেন, গ্রাম সংসদের মাধ্যমে উন্নয়নমূলক কাজের হিসেব নিকেষ যেমন দেওয়া হচ্ছে তেমনি জনগনের চাহিদা অনুযায়ী উন্নয়ন মূলক কাজও প্রনয়ন করা হয়। শুধু তাই নয় , জনগনের মাধ্যমেই গ্রামীন উন্নয়নমূলক কাজ রচিত হয়। তিনি উন্নয়নমূলক দিয়ে জানালেন, মৎস দপ্তরের উদ্যোগে এই পঞ্চায়েতের ১০টি মৎসজীবি পরিবারকে বিভিন্ন প্রকল্পে মাছের পোনা সহ মাছ চাষের উপকরন দেওয়া হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে রয়েছে ২.৫ কিমি পাকা এবং ১.৫কিমি ইট সলিং রাস্তা। বর্তমানে ৪.৫ কিমি কাঁচা রাস্তা পাকা করার পরিকল্পনা রয়েছে। তিনি আরও জানান, গ্রামের ৩৯৪জনের রেগার জবকার্ড রয়েছে। তারাই গ্রাম উন্নয়নের জন্য স্থায়ী সম্পদ সৃষ্টির কাজ করে চলেছেন।
এবছরও্এই গ্রামে ২০,৯৮৪টি শ্রমদিবসের মাধ্যমে ২৮টি চাষযোগ্য জমি সমতলকরন,৯টি নালা সংস্কার ,১০টি কিচেন গার্ডেন তৈরী,৫টি রাস্তা সংস্কার এবং ২টি পুকুর খনন করা হয়েছে।এছাড়া এম.জি.এন. রেগায় ২১০টি পরিবারকে সুলভ শৌচালয়ও নির্মান করে দেওয়া হয়েছে। পঞ্চায়েত উন্নয়ন তহবিল এবং ত্রয়োদশ অর্থকমিশনের অর্থেও এই পঞ্চায়েতে নানা উন্নয়ন কাজ রূপায়িত হয়েছে।
কৃষি দপ্তরের উদ্যোগে এ পঞ্চায়েতে এবছর এম. আই.ডি.এইচ প্রকল্পে ১২০জন কৃষককে বিভিন্ন সব্জী ৪০জনকে ২টি করে আম্রপালীর চারা দেওয়া হয়েছে। আমন মরশুমে ৫০জনকে এবং বোরো মরশুমে ৫০জন কৃষককে ১৫ হেক্টর জমিতে শ্রী পদ্ধতিতে ধান চাষের জন্য উচ্চফলনশীল ধান বীজ এবং ৮০ জন কৃষককে কৃষি কাজে সার দিয়ে সহায়তা করা হয়েছে।
এখানে ৬৮হেক্টর চাষ যোগ্য জমি রয়েছে। সেচ যোগ্য জমির পরিমান ২৭ হেক্টর। টিলা ভূমি ৮০ হেক্টর। জলাশয় ৩ হেক্টর। গ্রমের ২০ হেক্টর জমিতে শ্রী পদ্ধতিতে প্রতি বছর দু’বার করে ধান চাষ করা হয়। গ্রমের সেচের সুবিধার্থে জলের উৎস হিসেবে রয়েছে কালাছড়া ও কাটাখাল। কালাছড়ায় আছে স্যুইস গেইট। এই জল জমিতে সেচের কাজে ব্যবহার করা হয়।এছাড়া রয়েছে ১টি গভীর নলকূপ, ৩টি অগভীর নলকূপ। এর থেকে পাইপ লাইনে বাড়ি বাড়ি জল সরবরাহও করা হয়। সব্জীচাষের সুবিধার্থে ১১৭টি হাইড্রেন পয়েন্টও রয়েছে। এছাড়া পরিশ্রুত পানীয় জলের সুবিধার্থে রয়েছে ১৩৫টি চাপাকল।
কৃষি, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের সাথে এ গ্রামে বৈদুতিক ব্যবস্থাও উন্নত করা হয়েছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলেই একে একে যখন সারা গ্রামময় বৈদ্যুতিক আলো জ্বলে উঠে, তখন সেই আলোর রশ্মিই বুঝিয়ে দেয় এ গ্রামের কোথাও অন্ধকার নেই। বৈদ্যুতিক আলোর মতো এ গ্রামের মানুষ শিক্ষার আলোতেও উজ্জ্বল। সাক্ষরতার দিক দিয়ে এগ্রাম এখন পূর্ণ সাক্ষর গ্রাম রূপে বিকশিত। শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার জন্য এ গ্রামে ৬টি অঙ্গনওয়াড়ী কেন্দ্র আছে। এ গ্রামে শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধির জন্য রয়েছে ১টি উচ্চবিদ্যালয় ও ১টি মাদ্রাসা। এছাড়া গ্রামের কাছাকাছি রয়েছে একদিকে নন্দননগর উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়,অন্যদিকে দুর্গাচৌধুরী পাড়া হেমন্ত স্মৃতি উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়। শিক্ষার পাশাপাশি স্বাস্থ্য পরিষেবার দিক দিয়েও উন্নত। এ গ্রামের ৫কিমি দূরত্বে জিবি হাসপাতাল এবং গ্রামের মধ্যেই রয়েছে এস.টি,জোসেফ নামে প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র। বিভিন্ন সামাজিক ভাতা প্রকল্পে গ্রামের ৩৬৪জন সামাজিক ভাতা পাচ্ছেন।
শহর জীবনের সুযোগ সুবিধা গ্রামের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পশ্চিম নোয়াবাদী পঞ্চায়েতে চলছে কর্মযজ্ঞের জোয়ার। এর ফলে গ্রামের প্রাত্যহিক জীবনে যেমন বাড়ছে স্বাচ্ছন্দ্য, তেমনি জীবন মানেরও ঘটেছে অগ্রগতি। এক কথায় ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের হাত ধরেই আজকের পরিবর্তিত চেহারায় এসে দাঁড়িয়েছে এই গ্রাম। মিশ্র জনবসতিপূর্ণ পশ্চিম নোয়াবাদী এগিয়ে চলছে হাতে হাত ধরে অভিষ্ট লক্ষের দিকে।