Enewstime Article Images
Feature

চেতনায় সশক্তিকরন বোধে অর্জন

 

A Bengali write up on Women empowerment

একুশ  শতকের নারীর প্রশ্ন করে - আমি কে ? তখন সত্যিই ভাবতে হয়, এই আমি কে'র ভাবনাটা মস্তিষ্ক থেকে মগজে অনবরত কেন বারবার আন্দোলিত হয়! প্রতিবছর আন্তর্জাতিক নারী দিবসে একটি বিশেষ থিম নিয়ে ভাবনা, কথা এবং কাজ শুরু হয়।

প্রতিবছর মেয়েদের জন্য নামাঙ্কিত একটি দিনে কেন বিশেষ ভাবনা- ? সেটা ভাবতে গেলে আমি কে- এই কথাটাও বার বার উঠে আসে। একবিংশ শতকেও সংবিধান যাই বলুক না কেন কোথাও কোথাও এখনো দেখা যায় মেয়েদের উইকার সেক্স বলে দাবিয়ে রাখার একটা চেষ্টা।

Women-empowerment-enewstime-Tripuraমেয়েদের জীবন জুড়ে রয়েছে শত সংগ্রামের কাহিনী। ঘরে বাইরে পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নারী সামাজিক বা ব্যক্তিগত দায়িত্ব গুলো পালন করলেও রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এখনো অনেক পিছিয়ে। এর মধ্যে নারীদের জন্য বিশেষ দিবসে ভালো ভালো ভাবনা চিন্তার কথা বলা হয়। এবছরের 'ডিজিট অল' শব্দটির সঙ্গে নারীদের জুড়ে দেওয়া হয়েছে। 'ডিজিট অল' শব্দটির সঙ্গে ডিজিটাল শব্দটির বিশেষ ধ্বনি সাম্য থাকলেও অর্থের দিক থেকে তা বহুদূর প্রসারী। শব্দটিকে ডিজিট অল বা ডিজিটাল বললেও আসল কথা হল ডিজিটাল প্রযুক্তির যে রমরমা বিশ্ব জুড়ে চলেছে তার প্রতিটি ক্ষেত্রে মেয়েদের অংশগ্রহণ ।

প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ভীষণভাবে লিঙ্গ সাম্য জরুরী।। লিঙ্গ সাম্য নিয়ে এত কথা !বাস্তব রূপ কি? ইউক্রেন যুদ্ধ হোক বা সম্প্রতি  কিছু কিছু হিংসাশ্রয়ী ঘটনার ক্ষেত্রেও আমরা দেখি মেয়েরা জীবনের নিরাপত্তার গ্যারান্টিতে গ্যারান্টি থাকেনা।এত মহাসমারোহে দিন পালনের যথার্থতা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন ।যুক্তি তর্কে আমরা পল্লবিত হই।

কৃষকের ক্ষেত থেকে দেশের নিরাপত্তায় মেয়েরা যতই শ্রম দিক  না কেন,সমানাধিকারের দায়িত্ব কাগজে-কলমে যতটা দেওয়া হয় বাস্তবে কতটা কি হলো? তা নিয়ে প্রতিবছর নতুন শব্দ চালে থিমভিত্তিক না করে,আমাদের অর্জিত বোধ গুলোকে নিয়ে এগিয়ে গেলে লিঙ্গ বৈষম্য মাথা চাড়া দিতে পারেনা।আমাদের  বেঁচে থাকা,শিক্ষা,স্বাস্থ্য,সুরক্ষা এই শব্দ গুলো কে সাজিয়ে গুছিয়ে কথায় ব্যবহার না করে কাজে লাগাবো কিভাবে ? একটু একটু করে ঐ যে ছোটবেলার আমি কে  বোধের মধ্যে জারিত হয় ,সেখান থেকে নিজেকে বের করে আনতে পারাটা অর্জন।।আর সে অর্জন সম্পূর্ণ ব্যাক্তিগত হলেও এর শিকড় পরিবারের মধ্যে থাকে অনেক সময়। আবার কেউ কেউ শিক্ষা ও পারিপার্শ্বিক থেকে তা গ্রহণ করে ।আমি কে -তার উত্তর খুঁজে বের করে সশক্তিকরনের আধার হয়ে সামাজিক, পারিবারিক ,অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক পরিচয় বহন করে।

কিন্ত আমরা যদি আরো একটু বৃহত্তর ক্ষেত্রে গিয়ে প্রতি ইন্ডিভিজুয়াল নারী পুরুষের  মনকে বিশ্লেষণ করার একদম প্রাথমিক চেষ্টা করি,তাহলে যা পাই,তা হলো প্রত্যেকের মধ্যে রয়েছে সদর্থক ভাবনাবাহী মন। এই ব্যক্তিগত মন টা হলো আধ্যাত্মিক সশক্তিকরনের আধার।

ক্ষমতায়ন-অর্থনৈতিক ,সামাজিক,রাজনৈতিক, পারিবারিক যাই হোক না কেন  সশক্তিকরনের ক্ষেত্রে স্পিরিচুয়াল এমপাওয়ারমেন্ট কতটা গুরুত্বপূর্ণ?।
স্পিরিচুয়াল মানে ধর্মের মোড়ক নয়- এটা আমাদের প্রাথমিক ধারনার প্রথম সূচক।

নারী ক্ষমতায়নের অন্য দিকগুলো নিয়ে যত বারবার কথা বলা হয় এই স্পিরিচুয়াল এমপাওয়ারমেন্ট এর জায়গাটা নিয়ে আমরা খুব একটা কথা কেউ বলি না । নারী সশক্তিকরনের ক্ষেত্রে স্পিরিচুয়াল এমপাওয়ারমেন্ট কতটা জরুরী  এই প্রসঙ্গে  ড.সুচরিতা চৌধুরী ( প্রাক্তন অধ্যাপক  )বললেন"স্পিরিচুয়াল এমপাওয়ারমেন্ট   বা আধ্যাত্মিক সশক্তিকরন হলো এমন একটি শক্তির অনুভব যা  মানুষকে নিজের বোধের উন্নয়নের দ্বারা  নিজেই অর্জন করতে হয়। মানুষ হিসেবে নিজের করণীয় কাজগুলো সম্পর্কে সচেতন থাকা এই বোধের অন্যতম প্রকাশ। এই বোধ মানুষকে তার ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতির চিন্তার সীমানা পেরিয়ে বহু মানুষের কল্যাণের কাজে যুক্ত হতে শক্তি ও সাহস দেয়।

এক্ষেত্রে বিশেষ জরুরি হল এটা বুঝতে পারা যে ধর্মমত নির্দিষ্ট আচার-আচরণ বা অনুষ্ঠান পালনের সঙ্গে আধ্যাত্মিকতার কোন আবশ্যিক সম্পর্ক নেই কারণ রিলিজিয়ন এবং ধর্ম সমার্থক নয়। রিলিজন বহু কিন্তু ধর্ম এক। প্রতিটি মানুষের ধর্ম মনুষ্যত্ব হলেও মানুষ নানা ধর্মমতে বিশ্বাস করে। স্থান কালের সীমানায় বসে বিশেষ বিশেষ মত নির্ভর ধর্মীয় আচরণের নিয়ম নির্দেশ করে। এর সঙ্গে যখন মানুষের ধর্মের কোন বিরোধ হয় না, তখনই তা আধ্যাত্মিক হতে পারে। অন্যভাবে বলা যায়, প্রচলিত ধর্মমত নির্দিষ্ট আচার অনুষ্ঠান ছাড়াও মানুষ আধ্যাত্মিক শক্তির কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে। মানুষের ইচ্ছা শক্তি হলো প্রকৃত শক্তি যা মানুষকে পৃথিবীর প্রতিটি সৃষ্টির জন্য কল্যাণের কাজে যুক্ত হতে প্রেরণা  দেয়। তাই আধ্যাত্মিক শক্তি হলো যথার্থ অর্থে মানবিকতার বোধ, যার সাহায্যে ধর্মের প্রকৃত অর্থকে প্রতিফলিত করা যায়। 

এই প্রসঙ্গে মহিলাদের সামর্থ্যের কথা যদি বলা যায় তবে বলতে হয় - ব্যক্তি সীমা অতিক্রম করে বহু জনকে আপন করে নিয়ে সৃষ্টিকে ধারন করার মধ্য দিয়ে তাকে টিকিয়ে রাখার মত মানসিক প্রসারতা তাদের জন্মগত অর্জন। তাই কয়েকটি ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছাড়া, সামাজিক প্রথার মধ্য দিয়ে এই রীতি প্রায় সমগ্র পৃথিবী জুড়েই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে যে, পরিবার গঠন করার জন্য মহিলারাই তাদের ব্যক্তিগত গণ্ডি ছেড়ে বেরিয়ে এসে নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেবেন। 
পুণ্য লাভের মাধ্যমে মৃত্যুর পর স্বর্গ লাভের রাস্তা তৈরি করার চেষ্টা না করে দৈনন্দিন জীবনের কাজের মাধ্যমে পৃথিবীর মানুষের প্রয়োজনে মানুষের কাছে থাকার মানসিক প্রেরণাকে আধ্যাত্মিক সশক্তিকরণ বলা যায়।"

বাংলা র অধ্যাপক ড.পিনাকী মাইতির কথায়- "আমার মতে স্পিরিচুয়াল এমপাওয়ারমেন্ট আদৌ নারী ক্ষমতায়নের কোনো নির্ণায়ক হতে পারে না। নারীর অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন পিতৃতান্ত্রিক আধিপত্যকে যে ঝাঁকুনি দিতে পারে বা পাওয়ার স্ট্রাকচারে যে গুরুত্বপূর্ণ ন্যারেটিভ নির্মাণ করতে পারে তা কখনোই নারীর স্পিরিচুয়াল এমপাওয়ারমেন্ট হতে পারে না।  "

আবার অন্য দিকে-ড.শৌভিক বাগচি (সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা, ) বলেন, "এমপাওয়ারমেন্ট মানে ক্ষমতায়ন |ক্ষমতায়ন নির্ভর করে অন্তর্নিহিত দেবত্ব শক্তির বিকাশে |আমাদের ভারতবর্ষ অধ্যাত্মিকতার বিকাশে তার জাতিসত্তাকে এক সূত্রে বেঁধে রেখেছে |এই দেশে নারীর ক্ষমতায়নের মূল কথা, নারীর অপরিমেয় মাতৃত্বের বিকাশ |আর এই জন্যই আধ্যাত্মিক বিকাশের মধ্যে দিয়ে নিজের আত্মবিশ্বাস, ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া প্রয়োজন |তাহলেই নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে আত্মবিশ্বাস কে সহচর করে নারী এগিয়ে যাবে|মানসিক দিক থেকে স্থিতধী তাকে লক্ষ্যে অবিচল রাখবে।"

অঞ্জলি সেনগুপ্ত'র মতে- (সম্পাদক অন্যদেশ), "Spiritual  শব্দটি আমি সম্পূর্ণ ধর্ম বর্হিভূত ভাবি। আধ্যাত্মিক শব্দটিই  সঠিক মনে হয় ।  ভাবনা যার সদর্থক, যা পজিটিভ, তাই আধ্যাত্মিক।  প্রসারিত মন,  উদার দৃষ্টিভঙ্গিই মানুষকে প্রসারিত করে।  মানুষের জন্য  মানুষ - এই থিওরি প্রতিজন মানবের ( সে নারী হোক কিংবা পুরুষ)  আত্মোপলব্ধির প্রাথমিক  সূচক হওয়া উচিত।  নারী পুরুষ এই বিশ্বসৃষ্টিতে  আপাত দৃষ্টিতে সমান হলেও, একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, কি পরিবার কি সমাজ গঠনে পুরুষের থেকেও নারীর অবদান অনেক বেশি। কারণ নারী পুরুষের জন্মদাত্রী ও শিক্ষাদাত্রী। যে পরিবারে নারী উদার বৈজ্ঞানিক মনস্ক ও মুক্তমনা  ( spiritually enlightened)  সেই পরিবারগুলিই উন্নত সমাজ গঠন করতে সক্ষম হয়। 

সৃষ্টির মূলেই তো প্রসারতার কথা রয়েছে।  অনাহূত ( হৃদয় ভূমি)  চক্রের পাপড়িগুলি খুলে নতুন সৃষ্টির ব্যাকুলতাই  তো সৃষ্টির মূল। 
তাই spiritual empowerment  এর নিরিখে নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টি ভাবা যেতেই পারে।  "

সচেতনতা এবং আধ্যাত্মিক ক্ষমতায়ন নারীর সশক্তিকরনে একটি সূচক- যা অর্জন করা নিজেকে জাগিয়ে রাখার চাবিকাঠি। এবং তা সমাজে নারীর মর্যাদা বৃদ্ধি করে। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং এর সাথে যে আর্থিক নিরাপত্তা আসে তা নিঃসন্দেহে একজন নারীকে আত্মবিশ্বাস দেয়। তবে নারী যদি নিজের মধ্যে আত্ম-সচেতনতা এবং আধ্যাত্মিক শক্তিতে সুসজ্জিত না হন তবে  উচ্চ শিক্ষা এবং একটি উচ্চ পদে চাকরির সাথে যে আত্মবিশ্বাস থাকা দরকার  তা টিকিয়ে রাখা কঠিন। এই কারণেই অনেক সময় নারীর আত্মসম্মানে টান পড়ে এবং তারা আত্মসম্মানকে ধরে রাখতে পারেন না। এভাবেই তার নিরাপত্তার দিকটি ও আঘাত প্রাপ্ত হয়।

অবসর প্রাপ্ত বাংলার অধ্যাপক সুতপা ভট্টাচার্যের মতে, "স্পিরিচুয়াল এমপাওয়ার মেন্ট হলো জীবন শৈলির রহস্য আবিষ্কার এবং মূল্য বোধ শিক্ষা লাভ। "

 

সিনিয়র জার্নালিস্ট সুজিত চক্রবর্তী র মতামত- " কোন ধারণা অন্ধভাবে গ্রহণ বা বিশ্বাস  করা নয়,যুক্তি দিয়ে চেতনায়  যে বোধ জাগে, আধ্যাত্মিক ক্ষমতায়ন তাই।এইবোধ অবশ্যই পুরুষ ও নারী উভয়ের জন্য ।উভয়কেই এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে এবং তা  সকলের হিতের জন্য।"

 

অবসর প্রাপ্ত অধ্যাপক ড. পল্লব ঘোষালের মতে,"আধ্যাত্মিক ক্ষমতায়ন এর সাথে নারী ক্ষমতায়নের কোন সম্পর্ক বা এটা নারী ক্ষমতায়নের আদৌ  কোন সূচক হিসাবে আমি তো relate করতে পারছিনা। কারণ আমি যতটা বুঝি আধ্যাত্মিক ক্ষমতায়ন কোন ধরনের নিজের কোন কাজে absorption নয়। আমি যতটা বুঝি এটা তো  মৌলিকভাবে আমাদের ব্যক্তিগত আত্মের বাইরে কিছুর সাথে সংযোগ করার বিষয়।"

নারীর সশক্তিকরন আর ক্ষমতায়নের মধ্যে যে সূক্ষ ফারাক যুক্তিবাদী চেতনা, সশক্তিকরনের যে নির্যাস নিয়ে আসে তাই তো আধ্যাত্মিক সশক্তিকরন যা উইমেন এমপাওয়ারমেন্টের ক্ষেত্রে সূচক হিসাবেও ভাবা হয়।

এই  বোধ বা চেতনা মানুষ কে জাগ্রত করে।  সেই বোধ বা চেতনাকে ক্রমাগত প্রশ্ন করে শান দিতে হয়। অথচ শানের পরিবর্তে কিছু অশিষ্ট ধ্যানধারনার শ্যাওলাতে বোধ, চেতনা, বিবেক - হারিয়ে যায়। পণ্য হয় ছোট ছোট ব্যক্তিগত লাভের কড়িতে।ফলত একদিকে নারী জাগরণের নানা প্রকল্পে অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের সূচকে  বিকাশের কথা বলা হলেও সবার জন্য যে চেতনার সশক্তিকরন তা খুঁজে দেখতে গেলে আমাদের‌ দেখতে হয় ভগিনী নিবেদিতা, সারদা দেবী, মাদার টেরেজা , শ্রী মায়ের জীবন চর্চায়।আর স্বামীজী নারীর শিক্ষায় ব্যাবহারিক শিক্ষার সাথে গুরুত্ব দিয়েছিলেন আধ্যাত্মিক শিক্ষার।সেই চেতনার সৌরভ শিবজ্ঞানে জীব সেবা। মন্দিরে মসজিদে গীর্জায় নয় , মানুষের মানবিক হৃদয়ে।যার মূলে ফিরে যেতে হয় আমি কে- এই প্রশ্নে।আমার আমিত্ব ছেড়ে সচেতনতার সশক্তিকরনে। 

 

(Nandita Dutta may be contacted at [email protected])

(Also published in other media)

You can share this post!