Paramita Gharai
January 01, 2018: অন্ধকারের বুক চিরে নিস্তব্ধতার শক্ত প্রাচীর টুকরো টুকরো হয়ে পাহাড়ের গায়ে আছড়ে পড়ল। হাড় হিম করা গর্জনের সাথে রাতের তারার মতোই জঙ্গলের অন্ধকারে জ্বলজ্বলে দুটো চোখকেই দেখতে পেয়েছিল কালু কর্মকার । তার সাথে চোখের সামনে থেকে নিমেষে উধাও হয়ে যেতে দেখেছিল সঙ্গীটিকে। রঘুনন্দন পাহাড়ের চুড়োয় ঘন জঙ্গলের মাঝে কনকনে ঠান্ডা হাওয়া কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে গিয়েছিল। কালু কর্মকারের ছেনির ওপর হাতুড়ির ঘা তবুও থামেনি। আকাশের কোটি তারাকে সাক্ষী রেখে এই রাতেই কর্মকারকে শেষ করতে হবে কোটি সংখ্যক দেবমূর্তি। স্বয়ং মহাদেবের স্বপ্নাদেশ। একটিমাত্র রাত সময়, তার মধ্যেই শেষ করতে হবে এই ভাস্কর্য, তবেই সে আশ্রয় পাবে মহাদেবের কোলে, কৈলাশ পর্বতের শিবালয়ে। শ্বাপদের আগমন হয়তো বা স্বয়ং দেবাদিদেবেরই পরীক্ষা কৌশল। উত্তর ত্রিপুরার কৈলাশহরের কাছে ঘন জঙ্গলে ঢাকা রঘুনন্দন পাহাড়কেই বেছে নিয়েছে কালুকামার তার সিদ্ধিলাভের আশায়। স্বপ্নাদেশ কার্যকরী করতে সঙ্গীসাথী জুটিয়ে আকাশের মঘা নক্ষত্রকে সাক্ষী রেখে কনকনে শীতকে হেলায় দূরে সরিয়ে হাতুড়ি আর ছেনির ঘায়ে পাথর কেটে তুলে আনছে একের পর এক অবয়ব -বিভিন্ন ভঙ্গিমায় মহাদেবই সংখ্যাধিক। পাথুরে পাহাড়ের বুক চিরে একে একে আবির্ভূত হচ্ছেন বিষ্ণু, গণেশ, পার্বতীসহ নানা দেবদেবী।
টুপটাপ করে ঝরে পড়া শিশির চুঁইয়ে নামছে কামারের বাহু বেয়ে। বাহুমূলের পেশীর ভাজে ভাজে জমে থাকা শিশির চকচক করে উঠছে চাঁদের আলোয়। অবিশ্রান্ত হাতুড়ির ঘায়ে বিনিদ্র সঙ্গীদের নিয়ে কাজ প্রায় শেষের পথে। কুয়াশার চাদরে মোড়া জঙ্গলের ওপরে অস্তগামী চাঁদ ঢলে পড়েছে আকাশের কিনারায়। আর মাত্র একটা অবয়ব, তারপরই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করবে কালুকামার। সহকারী ভাস্করকে দায়িত্ব দিল কামার শেষ মূর্তিটি খোদাই করবার জন্য। আর নিজে হাত লাগাল নিজের মূর্তি বানানোর কাজে। দেবদেবীদের সাথে তার অবয়বও যেন চিরস্থায়ী হয় ইতিহাসের বুকে!
প্রথম ঊষার আলো এসে পড়ল কামারের পূর্ণ অবয়বে, পাহাড়ের গায়ে। কামার প্রণাম জানালো সূর্যদেবকে। প্রণাম জানালো মহাদেব কে। কিন্তু এ কি ! মহাদেব তো দেখা দিলেন না! তবে কি পূর্ণ হয়নি তার সাধনা? অজানা আশঙ্কায় ছুটে গেলেন সহকারী বন্ধুটির কাছে। হায়!অর্ধসমাপ্ত দেবমূর্তির নীচে অকাতরে ঘুমোচ্ছে সহকারী ভাস্কর। মাথায় হাত দিয়ে বসল কালুকামার। নিজের ভাস্কর্য বানাতে গিয়ে কি ভুলই না সে করে বসল! কালুকামারের কৈলাস বাসের বাসনা অধরাই রয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু কোটির থেকে একটা কম দেবমূর্তি আজও ছড়িয়ে আছে রঘুনন্দন পাহাড় আর পাহাড় সংলগ্ন গ্রামগুলোতে। ”ঊনকোটি” (Unakoti) উত্তরপূর্ব ভারতের এক বিস্ময়কর শিল্পভূমি।