।।প্রসেনজিৎ চৌধুরী।।
একটি শিক্ষিত ও কুসংস্কার মুক্ত সমাজ এগিয়ে চলার পথে যে কোন বাধাকে সহজে জয় করতে পারে। যে সমাজ ও দেশ শিক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছে তারাই পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত, পরিশীলিত সভ্য সমাজ ও দেশ বলে পরিগনিত হয়েছে। ত্রিপুরায় রাজ্য সরকারও শিক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছে। রাজ্যের প্রতিটি জনপদে গড়ে তোলা হয়েছে অঙ্গনওয়াড়ী কেন্দ্র ও বিদ্যালয়। যাতে রাজ্যের দূরবর্তী এলাকার শিশুরাও শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত না হয়। তাছাড়া পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর শিশুদের যাতে শিক্ষা গ্রহনে কোন বাধা না আসে এর জন্য আবাসিক বিদ্যালয়েরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু এত কিছুর পরও ছাত্র সমাজের একটি অংশ বিভিন্ন কারণে মাঝ পথেই পড়াশোনা ছেড়ে দেয়। এক্ষেত্রে ছাত্রদের চাইতে ছাত্রীদের সংখ্যাই বেশি। এরকম ৬ থেকে ১৪ বছর বয়সী ড্রপ আউট ছাত্রীদের পুনরায় পড়ালেখার জগতে ফিরিয়ে আনতে রাজ্যের একাধিক জেলায় সর্বশিক্ষা অভিযান প্রকল্পে খোলা হয়েছে রেসিডেনশিয়াল স্পেশাল ট্রেনিং সেন্টার। যেখানে বাছাই করা ড্রপ আউট ছাত্রীদের শিক্ষা গ্রহনের জন্য পাঠানো হয়।
এরকম একটি ট্রেনিং সেন্টার রয়েছে ধলাই জেলার কমলপুর মহকুমায় সালেমা ব্লকের মেন্দী এ ডি সি ভিলেজে। মেন্দী হাই স্কুলের ঠিক উত্তর প্রান্তে এক অনুচ্চ টিলার উপর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি খোলা হয়েছে। এর দায়িত্বে রয়েছেন মেন্দী হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক মনোরঞ্জন দেববর্মা। তিনি জানান, ২০১৩ সালের ৬আগষ্ট থেকে এর যাত্রা শুরু হয়েছিল। বর্তমানে এই সেন্টারে ৩৪ জন ছাত্রী রয়েছে। প্রত্যেকেই প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেনীর পড়ুয়া। সর্বশিক্ষার নিয়ম অনুযায়ী নবম শ্রেনীতে ওঠার পরই ছাত্রীদের অন্যত্র সরকারী আবাসিক বিদ্যালয়গুলোতে পাঠানো হয়। এখন পর্যন্ত ১৫ জন ছাত্রীকে বিভিন্ন স্কুলে নবম শ্রেনীতে ভর্তি করানো হয়েছে। প্রধান শিক্ষক জানালেন, সেন্টার পরিচালনার জন্য রয়েছেন ১ জন করে ওয়ার্ডেন ও স্পেশাল ট্রেইনার। দুই জন রান্নার লোক এবং এক জন নাইট গার্ড। সেন্টার পরিচালনার সরকারি বরাদ্দের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাদের থাকা খাওয়ার খরচ, লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার জন্য বই, খাতা, কলম সব কিছুই রাজ্য সরকারই বহন করে।
কথা হল আবাসিক ছাত্রীদের সাথেও কথা হয়। আলোচনা হয় ওয়ার্ডের ঝুমা দেববর্মার সঙ্গেও। তিনি জানালেন, আবাসিকদের প্রতিদিন সকাল ৬টায় প্রাতঃরাশ এবং সকাল ৯টায়, দুপুর ১টায় ও রাত্রি ৮টায় খাবার পরিবেশন করা হয়। নিয়ম করে প্রতিদিন সকালে ২ ঘন্টা এবং রাতে এক ঘন্টা তাদের পড়ানো হয়। এক্ষেত্রে তাকে সাহায্য করেন তার সহকর্মী সুনীতি দেববর্মা। তাছাড়া, প্রতি শনিবার ছাত্রীদের মনোবিকাশের জন্য সাহিত্য সভার আয়োজন করা হয়ে থাকে। এই সভায় ছাত্রীরা নাচ, গান, আবৃত্তি, নাটক ইত্যাদি নিজেদের মতো করে পরিবেশন করে।
সেন্টারেরই এক ছাত্রী বন্দেরুং রিয়াং-এর কাছে এখানে থাকার অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে সে জানায়, তার বাড়ী আমবাসা ব্লকের ভগীরথ রিয়াং পাড়ায়। বাবা জুম চাষী। তৃতীয় শ্রেনীতে উঠার পর আর্থিক অনটনের জন্য পড়াশুনা ছেড়ে দিতে হয়েছিল। কিন্তু আজ সে ক্লাস এইটের ছাত্রী। বাড়ীর কথা জিজ্ঞাসা করার সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠে বাড়ি থেকে এত দূরে থাকতে হয় বলে কখনো কখনো মন খারাপ লাগে। কিন্তু জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে একটু কষ্ট তো সহ্য করতেই হবে – নিজেই আপন মনে বিড় বিড় করে বলে। একই ধরনের কথা কালিমছড়ার কশমালা ত্রিপুরা, গঙ্গানগরের কিরনমালা ত্রিপুরা ও ডুপিছড়ার পাপিয়া দেববর্মাদেরও মুখে শোনা গেল।
সেন্টারের ওয়ার্ডেন ঝুমা দেববর্মা জানালেন, এখানকার ছাত্রীরাই মেন্দী হাই স্কুলের প্রতিটি ক্লাশের মেধা তালিকায় প্রথম দিকেই থাকে। আর্থিক প্রতিবন্ধকতায় এই সকল ছাত্রীরাই হারিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সরকারি সাহচর্য ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্তে আজ তারা জীবনের তমসার নাগপাশ কাটিয়ে এক সুন্দর আলোকজ্জ্বল প্রভাতের অভিযাত্রী।