Paramita Gharai: Kolkata: Sep 30: নিরুপমা কে মনে পড়ে? রবি ঠাকুরের ছোটগল্প ‘দেনাপাওনা’র নিরুপমা। শুধুমাত্র পণের দশহাজার টাকা দিতে না পারার অপরাধে তার বাবা রামসুন্দর তাকে পুজোর সময় বাড়ি নিয়ে যেতে পারেনি। রায়বাহাদুরের পুত্রবঁধূ এরপর অযত্নে, অনাদরে, স্বেচ্ছা উপবাসে মৃত্যুকে আশ্রয় করে। স্বামী ও সমাজের প্রতি তীব্র অভিমানে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, ‘যতক্ষণ টাকা আছে ততক্ষণ আমার দাম?’
দেবীপক্ষের সূচনা আজ। আমাদের অনেকেরই ঘুম ভেঙেছে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চন্ডীপাঠ শুনে। আগামী দশদিন দেবীদুর্গার বন্দনায় মেতে উঠবে বাংলার মানুষ। সর্বমঙ্গলা মঙ্গলে, সর্বশক্তি–সর্বমুক্তি প্রদায়িনী, জ্ঞানদায়িনী, গুণময়ী দেবীর কাছে চেয়ে নেবে রূপ, যশ, জয়। ‘রূপং দেহি, জয়ং দেহি, যশং দেহি, সর্বং দেহি’। মাতৃশক্তি, নারীশক্তির আরাধনা আজকাল লক্ষ লক্ষ টাকার উৎসব।
তবুও আজও নিরুপমাদের ছবি এতটুকু বদলায়নি। অপুষ্টি, অবহেলা, অশিক্ষা, উপেক্ষা, নিষ্ঠুরতা, ভ্রূণহত্যা, ধর্ষণ, গার্হস্থ্য হিংসার ভয়ঙ্কর শিকার আজকের নিরুপমারাও। অনেক পরিবারই কন্যাসন্তান চায় না। অনেক কিছুর মধ্যে একটা কারণ হল, মেয়ের বিয়ের সময় বিপুল ব্যয়ভার কন্যাপণ হিসেবে বহন করতে হবে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে এই দরকষাকষি, আর্থিক লেনদেন, সম্পত্তির হিসেবনিকেশ আর বংশরক্ষার তাগিদে ‘মা’ বেচারীর আনন্দ–আকাঙ্খা নীরব আর্তনাদে পরিণত হয় – সেজন্যই বোধহয় ‘সুসভ্যতা উঠে এসে প্রাণপণে টিপে ধরে অজাত কন্যার কচি টুটি’। যদিও বা অনাকাঙ্খিত কন্যাসন্তানের জন্ম হয়, অনেকক্ষেত্রেই সে পরিবারে ‘মাতৃরূপেন সংস্থিতা’ হতে পারে না। কৈশোরে পদার্পণ করার আগেই তাকে পরিবার আর সমাজ জানিয়ে দেয়, সে প্রজনন পদ্ধতির এক যন্ত্রবিশেষ মাত্র – ‘সৃষ্টিরূপেন সংস্থিতা’ নয়। বিবাহিত জীবনেও নারী প্রান্তিকায়নের শিকার।
‘‘মশারি গুঁজে দিয়ে যেই শোয় তার
স্বামীর কালো হাত হাতড়ে খুঁজে নিল
দেহের সাপ ব্যাঙ,লাগছে ছাড় দেখি
ক্রোধে সে কালো হাত মুচড়ে বুক
বলল,শোন শ্বেতা,ঢলানি করবে না
কখনও যদি ওই আকাশে ধ্রুবতারা
তোমাকে ইশারায় ডাকছে দেখি আমি
ভীষণ গাড্ডায় তুমিও পড়ে যাবে,
শ্বেতার শ্বেত ঊরু শূণ্যে দুলে ওঠে
আঁকড়ে ধরে পিঠ,স্বামীর কালো পিঠ।’’
মন্ত্র উচ্চারিত হয় ‘জায়া রূপেন সংস্থিতা’।
মন্ত্র উচ্চারিত হয় ‘জায়া রূপেন সংস্থিতা’। কিন্তু বহুক্ষেত্রে জায়া ভূমিকাই কেমন যেন ঘোলাটে – চাকরীহীন স্ত্রীকে প্রতিরাতে নিজের মন-মানসিকতাকে তুচ্ছ করে স্বামীর লীলাসঙ্গিনী হতে হয় সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তার বিনিময়ে। নিজেদের আত্মপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নয়, বরং গয়না–শাড়ির বুনোটে সংসারজীবনকে সার্থক মনে করে নিজেদের অজান্তেই যেন এরা প্রান্তিকায়নের শিকার। ’যা দেবী সর্বভূতেষু শ্রদ্ধারূপেন সংস্থিতা’ – কিন্তু আজকাল এই শ্রদ্ধাই তো যেন উধাও হয়ে গেছে সামাজিক, পারিবারিক জীবন থেকে।
সর্বমঙ্গলা মঙ্গলে দেবীরা অর্থনৈতিক, সামাজিক, লিঙ্গভিত্তিক শ্রমবিভাজনেও বঞ্চনার শিকার। যুগ যুগ ধরে তা বহমান। পূর্বজাদের মতো এখনকার নারীও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গৃহশ্রমের মান্যতা পায় না। পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক কাঠামোয় লিঙ্গবৈষম্যের যূপকাষ্ঠে নারীর অমূল্যশ্রম মূল্যহীন। গৃহ রচনাকারী নারী খাদ্য ও অর্থের যোগানকারী পুরুষের সমান হতে পারে না। কিন্তু অনুচ্চারিত প্রশ্ন গুমড়ে মরে:
‘‘ছড়া যে বানিয়েছিল, কাঁথা যে বুনেছিল
দ্রাবিড় যে মেয়ে এসে গম বোনা শুরু করেছিল
আর্যপুরুষের ক্ষেতে, যে লালন করেছিল শিশু
সে যদি শ্রমিক নয়, শ্রম কাকে বলে?’’
আজ মহোৎসবে মেতে ওঠার মুহূর্তে, চন্ডীপাঠ শোনার কালে কিংবা অষ্টমী পুজোর অঞ্জলি দেবার সময় – একবারও মনে হোক নারীর এই বহুমাত্রিক প্রান্তিকায়ন। সংসারের দশভূজা যে জয়, রূপ, যশ-এর জন্য নিজের সবকিছু নিবেদন করে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত, সেজন্য সংসারে একটু হলেও মর্যাদা পায়। ভারতীয় সমাজে কন্যাসন্তানের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হোক শক্তিদায়িনী, জ্ঞানদায়িনী রূপে। সংসারে মেয়েরা আদরনীয় হোক কন্যারূপে, জায়ারূপে, মাতৃরূপে। নারীশক্তির আরাধনা মাটির প্রতিমায় নয়, বহমান জীবনে প্রতিফলিত হোক।