অখিল চন্দ্র দাস
ProMASS, Nov 03, 2016:
ছোট বড় পাহাড়ী ছড়া, উঁচু নীচু টিলা ভুমি, বিভিন্ন জাতের গাছ গাছালির সবুজ সমারোহের মাঝে গড়ে উঠেছে ছোট্ট জনপদ – বাঘমারা। ত্রিপুরার লংতরাই পাহাড়ের পাদদেশে ধলাই জেলার আমবাসা ব্লকে অবস্থিত উপজাতি অধ্যুষিত এই বাঘমারা। আমবাসা ব্লকের ১৫টি এ ডি সি ভিলেজ এবং ৭টি পঞ্চায়েতের মধ্যে বাঘমারা একটি। ধলাই জেলা সদর আমবাসা থেকে ৮ কি:মি: এগিয়ে গেলেই এই গ্রামের অবস্থান। বাঘমারার পূর্বে লংতরাই পাহাড়, পশ্চিমে লালছড়ি ভিলেজ, উত্তরে বলরাম ভিলেজ এবং দক্ষিনে কাঁঠালবাড়ি ভিলেজ। পাহাড় বেষ্ঠিত এই বাঘমারা গ্রামের ৭৩৮টি পরিবারের লোকসংখ্যা ৩১৬৪ জন। এরমধ্যে মহিলা ১৬২৯ জন এবং পুরুষ ১৫৩৫ জন। লোকসংখ্যার মধ্যে উপজাতি ২৯১১ জন, তপশিলী জাতি ১০৪জন, ও বি সি ১২৫ জন এবং সাধারন সম্প্রদায় ভুক্ত রয়েছেন ২৪ জন।
এই ভিলেজে ইন্দিরা আবাসন যোজনা এবং রাজ্য আবাসন প্রকল্পে পাকা বসত ঘর পেয়ে উপকৃত হয়েছেন লালজয়কিম হালাম, বিরসৎ লক্ষ্মী হালাম এবং রেখা দেবনাথ সহ আরও অনেকে। তারা জানালেন ছন বাঁশের ঘরে দিন কাটাতে হতো। ঝড় বৃষ্টি হলে ঘরের সবকিছু ভিজে যেতো। ভিলেজ কমিটি থেকে ঘর পাওয়াতে মাথা গোঁজার স্থায়ী ঠিকানা হয়েছে। বিভিন্ন সামাজিক ভাতা পাচ্ছেন ২১২ জন। এরমধ্যে বয়স্ক ভাতা প্রাপকদের মধ্যে রয়েছেন বাসন্তী মারাক, বৈজয়ন্তী মারাক, লালসনথিম হালাম প্রমুখ। কথায় কথায় তারা জানালেন, সরকারের প্রদেয় ভাতা পেয়ে সংসারের অভাব অনটন অনেকটা লাঘব হয়েছে। কারো কাছে হাত পাততে হয়না। এক কথায় নিজের পায়ে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর শক্তি পেয়েছেন।
ভিলেজ কমিটির চেয়ারম্যান প্রশান্ত মারাক এক সাক্ষাৎকারে জানালেন, প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে রয়েছে ১১টি অঙ্গনওয়াড়ী কেন্দ্র, জে বি ৬টি এবং এস বি স্কুল ৪টি। এই গ্রামে সাক্ষরতা কেন্দ্র রয়েছে ৪টি। সাক্ষরতার হার হচ্ছে ৯৬.৪ শতাংশ। বনাধিকার আইনে জমির পাট্টা পেয়েছেন ৪৫৪টি পরিবার। যাতায়াতের সুবিধার্থে ৪৪ নং জাতীয় সড়ক থেকে আমবাসা-মরাছড়া হয়ে পিচ রাস্তা সোজা চলে গেছে বলরাম গ্রাম পর্যন্ত। আরও একটি পিচ ঢালা রাস্তা বাঘমারা বাজার থেকে লংতরাই পাহাড়ের পাদদেশে টি এস আর ক্যাম্প পর্যন্ত চলে গেছে। এক সময় এই গ্রামের মানুষ জুম চাষের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। বর্তমানে যোগাযোগের সুবিধার ফলে আজ তারা জীবন জীবিকার নতুন পথ খুঁজে পেয়েছেন। চলতি অর্থ বছরে এম জি এন রেগা কাঁচা রাস্তা তৈরী ও সংস্কার এবং অনাবাদী জমি চাষযোগ্য করে তোলার কাজে ব্যয় হয়েছে ২০ লক্ষ ৭৬ হাজার ৩৫ টাকা। স্বচ্ছ ভারত কোশ-এর বরাদ্দ অর্থে গ্রমের ২৭৭টি পরিবারকে বিজ্ঞানসম্মত শৌচালয় নির্মাণ করে দেওয়া হচ্ছে। প্রতিটি শৌচালয় নির্মাণে ১২ হাজার টাকা ব্যয় হবে। পানীয় জলের সুবিধার্থে গ্রামে রয়েছে ২টি ডিপ টিউবয়েল, ১৫টি মিনি ডিপ টিউবওয়েল, ১৭টি পাকা কুয়া।
গ্রামে ২০৪৭ একর কৃষিযোগ্য জমি রয়েছে। কৃষি দপ্তর থেকে এ বছর ১০টি পরিবারকে অড়হর ডাল চাষ করার সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া শ্রীপদ্ধতিতে ২২৫টি পরিবারকে আমন ধান চাষে সহায়তা দেওয়া হয়েছে। ২টি পরিবারকে ১হে: আম বাগান করে দেওয়া হয়।
টি আর পি সি লি:-এর ব্যবস্থাপনায় এম জি এন রেগায় ৪ লক্ষ ৮৫ হাজার ৮৮০ টাকা ব্যয় করে ৫টি পরিবারকে ৫ হে: রাবার বাগান করে দেওয়া হয়। গ্রামের উপজাতি এবং তপশিলী জাতিভুক্ত মাছ চাষিদের স্বনির্ভর করে তোলার জন্য ভিলেজ কমিটি থেকে লুঙ্গা জমিতে বাঁধ দিয়ে জলাশয় তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। মৎস দপ্তর থেকে ১২১জন মৎস চাষীকে মাছের পোনা সহ বিভিন্ন সামগ্রী প্রদান করা হয়েছে। প্রানী সম্পদ বিকাশ দপ্তর থেকে ১০টি পরিবারকে শিমূল আলু চাষ করার জন্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে। হস্ততাঁত, হস্তকারু ও রেশম শিল্প দপ্তর থেকে এম জি এন রেগায় ১লক্ষ ১৬ হাজার ৮৬৯ টাকা ব্যয় করে ৫টি পরিবারকে সোয়া ছয় কানি তুঁত বাগান করার সহায়তা দেওয়া হয়। ত্রিপুরা স্টেট কো-অপারেটিভ মার্কেটিং ফেডারেশন লি:-এর ব্যবস্থাপনায় ৫০টি পরিবারকে ১কানি এলাকা পিছু গন্ধকী চাষে সহায়তা দেওয়া হয়। প্রতি কানি এলাকা গন্ধকী চাষে ব্যয় হবে ৭,৫০০টাকা।
গ্রামের আনারস চাষি দেবসন হালাম, সুরেন্দ্র রিয়াং, শচীন্দ্র রিয়াং, মৎস চাষী দেবরত রিয়াং, রোলথইরি হালাম, বিজয় রিয়াং, রাবার চাষী দহনচং হালাম এক জানালেন, আগে আমরা জুম চাষ করে অনেক কষ্টে জীবনযাপন করতাম, আর এখন সরকারী সহায়তায় স্ব-নির্ভরতার পথে এগিয়ে চলছি।
ভিলেজের চেয়ারম্যান প্রশান্ত মারাক জানান, জনগনকে সাথে নিয়ে আলোচনাক্রমে এই ভিলেজকে স্বাবলম্বী করে তোলার জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। ভিলেজকে আরও সাজিয়ে তোলার জন্য কৃষি, ফলচাষ, রাবার চাষ, প্রানী পালন, মৎস চাষ, পানীয় জল, আবাসন ইত্যাদির পরিকল্পনা গ্রহন করা হয়েছে। ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে ১৭৮৪টি ঔষুধিযুক্ত মশারি বিতরন করা হয়। গ্রামের ৯০ শতাংশ বাড়িতে বিদ্যুৎ পৌছে দেওয়া হয়েছে।
বাঘমারা পাহাড়ের ঢালে এখন আর ছনের ছাউনির ঘর চোখে পড়েনা। চারিদিকেই এখন চকচকে ঢেউটিনের ঘর। এক সময়ের সন্ত্রাসদীর্ন গ্রামে আজ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে শান্তি সম্প্রীতি ও সৌভ্রাতৃত্বের মেলবন্ধনে গড়ে উঠেছে আধুনিক জীবন। এক কথায় ধারাবাহিক উন্নয়ন কর্মকান্ডের ফলে এই গ্রামে আজ ধ্বনিত হচ্ছে উন্নয়নের সুর।