।।মনোরঞ্জন দাস ।।
ProMASS, Nov 24. 2016: শুধু চিত্ত বিনোদন বা মনোরঞ্জনই নয়। এক একটা যাত্রা-নাটক এক একটা সময়কালের বাস্তব চিত্র। মানুষের ধর্ম শিক্ষা, নীতিকথা শিক্ষা, ইতিহাস চেতনাবোধ ও সামাজিক মূল্যবোধ সবই এক সময় যাত্রা- নাটকে ফুটে উঠতো। শুধু তাই নয় মানুষের সম্পর্কের ভাঙ্গা গড়া ও জীবন জীবিকার পরিবর্তন ও রুটিরুজির সংগ্রাম ও যাত্রা-নাটকের মূল উপজীব্য বিষয় ছিলো। কিন্তু কালের নিয়মে বর্তমান ইন্টারনেট যুগে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির দাপটে ঘরে ঘরে চ্যানেল ও সিরিয়াল সংস্কৃতির অনুপ্রবেশের ফলে য়াত্রা হয়ে পড়ে দুর্লভ বা লুপ্তপ্রায় সংস্কৃতি। এ যেন ঐ সামাজিক যাত্রাপালার মতো ‘ সংসার শেষ, বৌমা নিরুদেশ’।যাত্রা যেন এখন নিরুদ্দেশ। অথচ একটা সময় ছিল পূজোর ঢাকে কাঠি পড়লেই পাড়ার মহরায় যাত্রা নাটকের মহড়া শুরুহতো।শীত শুরু হলেই গ্রাম ও শহরতলীতে যাত্রার প্যান্ডেল পড়ত। সে এখন প্রায় অতীত।
কিন্তু হতাশ হওয়ার কিছু নেই। আমাদের রাজ্যে যাত্রা শিল্পের প্রসারে ত্রিপুরা সরকার এগিয়ে এসেছে।তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের উদ্যোগে অধিকাংশ জেলাতেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে জেলা ভিত্তিক যাত্রা উৎসব।আগামী ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি দক্ষিন জেলার মতাইয়েও অনুষ্ঠিত হবে দক্ষিন ত্রিপুরা জেলা ভিত্তিক যাত্রা উৎসব। তারই প্রস্তুতি শুরু হয়েছে দক্ষিনের সাব্রুম, বিলোনিয়া ও শন্তিরবাজার মহকুমায়। তিন মহকুমায় আবার শুরু হলেছে নতুন করে যাত্রাপালার অনুশীলন। আবার একত্রিত হয়েছে যাত্রা শিল্পীরা। মোট ১০টি যাত্রাপালা এই উৎসবে মঞ্চস্থ হবে। ইতিমধ্যে সাব্রুমের রানীরবাজারে হয়েছে যাত্রা প্রশিক্ষন শিবির। ১৫-২১ নভেম্বর পর্যন্ত ৭দিন স্থানীয় ভগৎ সিংহ কমিউনিটি হলে অনুষ্ঠিত হয়েছে এই যাত্রা প্রশিক্ষন শিবির। আগরতলার বিশিষ্ট যাত্রা হারাণ সূত্রধর এই শিবিরে শিল্পীদের যাত্রা প্রশিক্ষন দিয়েছেন। সাব্রুম মহকুমার ১৮ জন যাত্রা শিল্পী এই শিবিরে প্রশিক্ষন নিয়েছে। সঙ্গে চলেছে যাত্রাপালার অনুশিলনও। বিলোনিয়া-শান্তিরবাজার মহকুমারও অনুরূপ যাত্রা প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়েছে।প্রবীণ যাত্রা শিল্পীদের সঙ্গে বহু নতুন ছেলেমেয়েরাও এসব প্রশিক্ষন শিবিরে যাত্রা পাঠ নিচ্ছেন।
অন্যদিকে, তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের উদ্দ্যোগে চলতি(নভেম্বর) মাসের প্রথম সপ্তাহে আয়োজিত হয় আন্ত:বিদ্যালয় নাট্যোৎসব। উদ্দেশ্য ছাত্রছাত্রীদের সুস্থ বিকাশ। মনু, বনকুল, কলাছড়া, হরিণা, পোয়াংবাড়ি, বৈষ্ণবপুর,সাব্রুম ও ছোটবিল জোনে ৪০টি নাটক ছাত্রছাত্রীরা মঞ্চস্থ করে। ৮টি জোনের প্রথম স্থানাধিকারী ৮টি নাটক নিয়ে দক্ষিণীতে আয়োজন করা হয় সাব্রুম মহকুমা ভিত্তিক আন্ত:বিদ্যালয় নাট্যোৎসব। হরিণা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের নাটক ‘পুনজন্ম’ নাট্যোৎসবে ১ম হয়ে দক্ষিন জেলা ভাত্তিক নাট্যোৎসবে অংশ গ্রহণের সুযোগ লাভকরে। স্কুলে স্কুলে ব্যাপক সাড়া পড়ে আন্ত:বিদ্যালয় নাট্যোৎসবের। ছাত্রছাত্রীদের নাট্য বিষয় ভাবনা অভিনবত্বের দাবী রাখে। দক্ষ অভিনয়,কোরিওগ্রাফি, আলো প্রক্ষেপন সব কিছুই শিল্পের সুক্ষ্ম বিচারে শ্রেষ্ঠত্বের দাবী রাখে। স্বচ্ছ ভারত, জাতীয় সংগীত, কুসংস্কার মুক্তি, নেশাদ্রব্য বর্জন,পনপ্রথা অভিশাপ সবকিছুই ছাত্রছত্রীরা এ যুগের সময়ের কষ্টিপাথরে বিচার করে নাটকের সংলাপে তুলেধরেছে। যা সকলের নজর কাড়ে। ইতিমধ্যে তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর থেকে গ্রামে গ্রামে লোকসংস্কৃতি উৎসবও আয়োজন করা হয়েছে। গ্রাম ভিত্তিক এই লোকসংস্কৃতি উৎসবএ বাউল, ভাটিয়ালি, ধামাইল,মনসামঙ্গল, যাদু-কলিজা, গড়িয়া, গাজন ইত্যাদি লোকসঙ্গীত ও লোকনৃত্য গ্রামীণ শিল্পীরা তুলে ধরেছেন। আবার গ্রামের বুড়ো বটতলায় শোনা যাচ্ছে দোতারা, একতারার ঝংকার ও ঢোলকের মন মাতানো বোল। ত্রিপুরার জাতিউপজাতির মিশ্র সংস্কৃতি আবার উতরে উঠেছে সংহতির মিঠে রসের ভিয়েনে।
ঝড়ের মুখে মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখা খুবই কঠিন কাজ। তেমনিই পাশ্চাত্য চ্যানেল ও সিরিয়াল সংস্কৃতির দাপটের মুখে সুস্থ সংস্কৃতির মঙ্গল দীপ জ্বেলে রাখাও কষ্টকর কাজ। কিন্তু একটা সুস্থ সংস্কৃতির ধারক ও বাহক জনকল্যানকামী সরকার মুখ বুজে থাকতে পারে না। আর তাই ত্রিপুরা সরকার রাজ্যে সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশে লুপ্ত প্রায় লোক সংস্কৃতিও যাত্রা নাটকের প্রসার ও প্রচারের কর্মসূচি গ্রহন করেছে। কারন অপসংস্কৃতি রুখেতে সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশ খুবই জরুরী। পরিকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে রাজ্যের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটানোর সঙ্গে সঙ্গে রাজ্য সরকার উন্নত সাস্কৃতিক মনন তৈরির কাজ করছে। সংস্কৃতি মনষ্ক মানব সমাজ ছাড়া উন্নয়নও উন্নততর সমাজ গঠন সম্ভব নয়। প্রতিনিয়ত সুচারু ভাবে রাজ্য সরকার নানা কর্মসূচির মাধ্যমে এই কাজ করছে। তাই আবার তৈরি হচ্ছে নাটমহল।রঙ্গমঞ্চে জ্বলে উঠবে নানা রঙিন আলো। কালের যাত্রাপালায় আবার ধ্বনিত হবে জীবনের সংলাপ।