দেশে লিঙ্গ সমানুপাতের সমস্যা দূর করতে সরকার বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও কর্মসূচি চালু করেছে। শিশুকন্যাদের ক্ষমতায়ন, তাদের শিক্ষার জন্যও এই কর্মসূচি। কন্যাভ্রুণ হত্যার মতো লিঙ্গ বৈষম্য দূর করে শিশুকন্যাদের বাঁচিয়ে রাখা ও তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে শিক্ষায় শিশুকন্যাদের অংশগ্রহণের ওপর এই কর্মসূচীতে জোর দেওয়া হয়েছে।
জাতি, বর্ণ, ধর্ম এবং সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে, কুড্ডালোর জেলায় মানুষ শিশুপুত্রকে আশীর্বাদ হিসেবে মনে করে এবং শিশুপুত্রের জন্ম হলে উত্সব পালন করা হয়। অন্যদিকে শিশুকন্যাদের বোঝা হিসেবে ধরা হয় এবং কন্যাসন্তান জন্মালে কোনো উত্সব হয় না। তাই, নারী-পুরুষের সমতার সামাজিক সূচক হিসেবে শিশুকন্যাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে ধরা যেতে পারে। লিঙ্গ সমতার ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা দেশের ১০০টি জেলার মধ্যে তামিলনাড়ুর কুড্ডালোর থাকায় এখানে বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও কর্মসূচি রূপায়ণ শুরু হয়েছে। ২০০১-২০১১ সাল, এই এক দশকের মধ্যে কুড্ডালোর জেলায় প্রতি ১০০০ পুরুষ পিছু মহিলার সংখ্যা ৯৫৭ থেকে কমে ৪৯৬ এ দাঁড়িয়েছে। ক্রমশ কমতে থাকা এই অনুপাতকে স্বাভাবিক করে তুলতে ২০১৫ সালের ১৪ই জানুয়ারি জাতীয় শিশুকন্যা দিবসে কুড্ডালোরে মারুঙ্গুর গ্রামে বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও কর্মসূচীর সূচনা হয়। সাধারণ মানুষের মধ্যে সাধারণভাবে মহিলাদের প্রতি এবং বিশেষ করে শিশুকন্যাদের প্রতি সদর্থক ভাবনা জাগিয়ে তোলার লক্ষ্যে গোষ্ঠীভিত্তিক বেশকিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় । যেমন প্রতিমাসের ৭ তারিখটিতে জেলার সমস্ত গ্রাম স্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং হাসপাতালগুলিতে বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও দিবস উদযাপন করা হয় । এই দিন জেলা সমাহর্তার স্বাক্ষর সম্বলিত একটি চিঠি প্রত্যেক শিশুকন্যার হাতে তুলে দেওয়া হয় । তাতে শিশুকন্যাদের সুবিধার্থে সরকারি প্রকল্পগুলির বিষয়ে তথ্য দেওয়া থাকে। এছাড়া তাদের হাতে আম ও কাঁঠালের চারা তুলে দেওয়া হয় কারণ এই গাছগুলি বড় হলে ওই সব শিশুকন্যাদের অর্থনৈতিক প্রয়োজন মেটাতে পারবে । এছাড়া তাদের হাতে কিছু উপহার সামগ্রী, ৭০০ টাকার জমা সহ সর্বশিক্ষা অভিযানের পাশবই প্রভৃতি তুলে দেওয়া হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে গ্রাম পঞ্চায়েতের পক্ষ থেকে শিশুকন্যার জন্য একগ্রাম সোনার একটি মুদ্রাও তুলে দেওয়া হয়।
জেলায় শিশুকন্যাদের সংখ্যা হ্রাস বিষয়ে সাধারণ মানুষকে অবগত করতে ৬৮৩টি গ্রাম পঞ্চায়েত ২৩৪২টি গ্রামে একটি করে বোর্ডে বালক-বালিকার সাম্প্রতিক লিঙ্গানুপাত বিষয়ে তথ্য ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। শিশু বিবাহ রুখতে কুড্ডালোর জেলায় প্রচার চালানো হয়েছে। এই ধরনের ১৩৬টি শিশু বিবাহের চেষ্টা বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে। বিবাহিত শিশুকন্যাদের পুনর্বাসনের জন্য তাদের নতুন করে স্কুলে পাঠানো বিভিন্ন পেশাগত কোর্সে ভর্তির চেষ্টা এবং যতদিন না ১৮ বছর হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত তাদের প্রতিমাসে ১০০০ টাকা করে সাহায্যের ব্যবস্থা হয়েছে। জেলায় বেআইনি ভাবে ভ্রণের লিঙ্গ নির্ধারণ বন্ধ করতে কড়া নজরদারি এবং পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে অন্তত ৭টি ক্ষেত্রে এই ধরনের বেআইনি স্ক্যান সেন্টারগুলির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সমস্ত জেলার সমস্ত স্ক্যান সেন্টারের মালিক এবং চিকিত্সকদের নিয়ে ওয়ার্কশপে ভ্রণের লিঙ্গ নির্ধারণ নিষিদ্ধকরণ আইন বিষয়ে বোঝানো হয়েছে। বহু সরকারি ভবন যানবাহন এবং স্কুলবাসে বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও কর্মসূচী, ভ্রণের লিঙ্গ নির্ধারণ নিষিদ্ধকরণ আইন বিষয়ে প্রচারপত্র লোগো এবং স্টিকার লাগানো হয়েছে।
তামিলনাডু সরকার বালিকাদের স্কুলে যাওয়াকে আরো উত্সাহিত করতে তাদের ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কিশোরী ছাত্রীদের জন্য স্কুল থেকে স্যানিটারি ন্যাপকিন সরবরাহ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঋতুস্রাব বিষয়ে তাদের মনের ভয়ভীতি দূর করতে শিক্ষিকারা যাতে তাদের বুঝিয়ে বলেন সে বিষয়ে নির্দেশ জারি করা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন স্কুলে যাতে ছাত্রীরা ব্যবহৃত স্যানিটারি ন্যাপকিন নষ্ট করে ফেলতে পারে তার জন্য ইনসিনারেটর যন্ত্র বসানো হয়েছে, আশার বিষয় এসব পদক্ষেপের পর স্কুলে কিশোরী বালিকাদের উপস্থিতির সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মহিলা এবং শিশুকন্যারা আমাদের গর্ব এই বিষয়কে মূল সূর করে দুই থেকে পাঁচদিন ব্যাপী বড় মেলা এবং উত্সবের আয়োজন করা হয়েছে। এই সব উত্সবে শিশুকন্যাদের এবং মহিলাদের জন্য সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, বিনামূল্যে স্বাস্থ্য শিবির, শিশুকন্যা প্রদর্শনী, শিশুকন্যাদের জন্য পোষাক পরার প্রতিযোগিতা প্রভৃতির আয়োজন করা হয়। মেলায় আগত মানুষজনকে বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও লোগো সম্বলিত রুমাল উপহার দেওয়া হয়েছে।
আগস্ট মাসে তিন দিন ধরে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের সহযোগিতায় জনতথ্য অভিযানে বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও কর্মসূচী নিয়ে প্রচার চালানো হয়। এছাড়াও শিশুকন্যাদের শিক্ষা, স্ব-সুরক্ষা এবং শিশুকন্যাদের জন্য সরকারি প্রকল্পগুলির বিষয়ে প্রচার চালানো হয়েছে। কুড্ডালোর জেলায় ৫৬ জন মহিলাকে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কাজের স্বীকৃতিতে সম্মান জানানো হয়েছে। বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও কর্মসূচীকে গণআন্দোলনে পরিণত করতে স্কুল এবং কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের বক্তব্য জানানোর জন্য বিনামূল্যে পোষ্টকার্ড দেওয়া হয়েছে। জেলায় শিশুকন্যা এবং বালিকাদের জন্য সুকন্যা সমৃদ্ধি যোজনার আওতায় জেলায় ৪৭ হাজার আকাউন্ট খোলা হয়েছে।
বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও কর্মসূচী নিয়ে প্রচার চালাতে সারা জেলায় একটি ভ্রাম্যমান প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়। জেলার ১৫০টি স্থানে এই ভ্রাম্যমান প্রদর্শনীযান ঘুরে ঘুরে প্রচার চালিয়েছে। জেলার বিভিন্ন স্থানে বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও কর্মসূচী ছাড়াও শিশুকন্যাদের বিষয়ে সদর্থক মানসিকতা গড়ে তোলার জন্য সভা সমিতি ও মিছিলের আয়োজন করা হয়।
তামিলনাড়ু সরকারের পক্ষ থেকেও শিশুকন্যাদের সুবিধার্থে যে সব প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে এ জেলায় সে বিষয়েও প্রচার করা হয়। এছাড়া ১১ থেকে ১৮ বছর বয়স্ক কিশোরী বালিকাদের বিভিন্ন সমস্যা দূরীকরণে বহুমুখী সবলা প্রকল্পও রূপায়ণ করা হচ্ছে। সারা জেলায় বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও কর্মসূচী যে আন্তরিকতা এবং দায়বদ্ধতার সঙ্গে রূপায়ণ করা হচ্ছে আশা করা যায় কন্যাশিশুদের শিক্ষার জন্য এই গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচী নিশ্চিত ভাবেই সফল হবে।
—— এস সুরেশ কুমার
(লেখক কুড্ডালোরের জেলা সমাহর্তা)