Paramita Gharai: Kolkata: Oct 12, 2016:
শারদোৎসবের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাব জড়িয়ে আছে ঢাক। উৎসব শুরুর কয়েকদিন আগে থেকেই শুরু হয় ঢাকিদের আনাগোনা। ঢাক ছাড়া শারদোৎসব যেন পূর্ণতা পায় না। তবে ঢাক বা ড্রাম মানবসভ্যতার আদিপর্ব থেকেই আন্তর্জাতিক।
যাবতীয় বাদ্যযন্ত্রের উৎপত্তি আমাদের জীবন থেকে। আমাদের চলার গতিতে আছে ছন্দ। দুই পা সমান ছন্দে,সমান লয়ে গতিময় হয়। আদিম মানুষ শিকার করা পশুর চামড়া পরিধান করল। উদ্বৃত্ত শুকনো চামড়া দিয়ে কোনো একদিন কোনো এক খেয়ালে ফাঁপা নলের মতো কাঠের টুকরোর দুধার ঢেকে দিল। তার ওপর আঘাত করে নিজেই অবাক হয়ে গেল। চলার ছন্দে আঘাত করে সৃষ্টি হল তাল। তাল আর ছন্দ মিলে গিয়ে হল আনন্দের প্রকাশ।
শব্দের এতো উঁচু স্বরগ্রাম, এতো গাম্ভীর্য যে পশু তাড়ানোর কাজে ব্যবহার করতে একে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করল না আদিম মানুষ। এর অনেক পরে যখন গ্রাম গড়ে উঠল, তখন ঢাক হয়ে উঠল গ্রাম থেকে গ্রামের সংবাদ বা সংকেত পাঠানোর মাধ্যম। তাই অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা, এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকার প্রত্যন্ত জঙ্গলে, গ্রামে আদিম জনজাতি, উপজাতিদের আদিম বাদ্যযন্ত্র ঢাক বা ড্রাম।
মধ্যযুগে ঢাক বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ব্যাপকহারে ব্যবহৃত হত। নাচ, গান, নাটক এ অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে ঢাকের ব্যবহারের উল্লেখ পাওয়া যায় মঙ্গলকাব্যগুলোতে। ইতিহাস বলে একাদশ শতকে দুর্গাপুজোর প্রচলন ছিল, যদিও এখনকার মতো মহোৎসবের আকারে নয়। তবে পুজোতে ঢাক বাজানোর প্রচলন ছিল। রাজার লোক গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঢাক বাজিয়ে লোক জড়ো করে রাজার আদেশ বা নির্দেশ গ্রামের লোকেদের জানাতো। কিন্তু ঢাকি সম্প্রদায়ের উল্লেখ পাওয়া যায় না। অষ্টাদশ শতকে ইংরেজ শাসনের সময় থেকে দুর্গাপুজো উৎসবের রূপ নিতে শুরু করে। ব্রিটিশ সরকারের নজরে আসার জন্য স্থানীয় রাজা ও জমিদারদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়। তার ফলে নিজেদের প্রতিপত্তি দেখানোর অন্যতম মাধ্যম হল দুর্গাপুজো। এসময়েই ঢাকিদের কথা বিশেষভাবে পাওয়া যায়। রথযাত্রার দিন প্রতিমার কাঠামো বাঁধা হয়। আধুনিক সভ্যতায় শারদোৎসবে ঢাক বাজানোর শুরু সেখান থেকেই। প্রতিমার আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা, পুজো, ধুনুচিসহ আরতি, বিসর্জনের বাজনা বা ঢাকের বোল আলাদা। ঢাক প্রথমে ধীর লয়ে বাজানো হয়। ক্রমে লয় দ্রুত হয়।
বাংলা ঢাক বানানো হয় সাধারণত আমগাছ থেকে। কান্ডের মাঝখানটা ফাঁকা করে দুদিকে ছাগলের শুকনো চামড়া দিয়ে দুধার আচ্ছাদিত করে। একধার থেকে অপরধার পর্যন্ত ঢাকটিকে ঘিরে থাকে সরু সরু মোষের চামড়ার ফিতে কিছুটা ফাঁক রেখে রেখে। ঢাকের কেবলমাত্র ডানদিকই বাজানো হয়। সেই শব্দের কম্পনে অপর দিকে কম্পন তৈরী হয়। সৃষ্টি হয় ধ্বনি। ঢাক বাজানো হয় সরু বাঁশের লাঠি দিয়ে। আবার স্থানভেদে ঢাকের আকার ও আকৃতির পরিবর্তন ঘটেছে। যেমন আসামের ঢাক লম্বাটে। ঢাক বাজানোর পদ্ধতিও এক এক জায়গায় একেক রকম। কোথাও হাত দিয়ে, কোথাও লাঠি দিয়ে, কোথাও বা একদিকে হাত অপরদিকে লাঠি দিয়ে বাজানো হয়।
ঢাক হল অনেক রকম তাল বাদ্যের উৎস। ভারতে ঢাক থেকে সৃষ্ট মাদল, মৃদঙ্গ, ঢোল, খোল ইত্যাদি সহ প্রায় ৪২ রকমের তালবাদ্য প্রচলিত আছে। যদি সব প্রদেশের ঢাক ও ঢাক থেকে তৈরী বাদ্যযন্ত্রগুলোকে একসাথে সাজান হয় তবে চোখে পড়বে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য।
নবপত্রিকা আরাধনা করে শুরু হয় দুর্গাপুজো যা একাধারে ফসলের উৎসব, মাটির ঊর্বরা শক্তি বৃদ্ধির উৎসব। আর সেই ফসল রক্ষার্থেই ঢাক / ড্রাম বাজিয়ে তাড়ানো হত পশু। তবে যা-ই হোক না কেন, ঢাকের বাদ্দ্যি ছাড়া শারদোৎসবে পুজো পুজো ভাবটাই যেন তৈরি হয় না।
Banner Photo Courtesy: Youtube