ক্ষিরণজয় রিয়াং
ProMASS, Agartala: Oct 26, 2016:
কার্তিকের অমাবস্যার নিশিথে একান্ন পীঠের অন্যতম ত্রিপুরার মন্দিরনগরী উদয়পুর মেতে উঠবে দেওয়ালি বা দীপান্বিতা উৎসবে। সেজে উঠবে আলোকের ঝর্নাধারায়। আর কয়েকটি দিনের অপেক্ষা। তারপরই ২৯ ও৩০ অক্টোবর, শুরু হচ্ছে রাজ্যের ঐতিহ্যবাহী দেওয়ালি মেলা ও উৎসব।
অন্ধকার থেকে আলোকে উত্তরনই মানব মনের চিরকালীন অভিপ্সা। আর অন্ধকার থেকে আলোয় উত্তরনের উৎসবই দীপান্বিতা বা দেওয়ালি। শরতের কাশবনের দোলা শেষ না হতেই চলে আসে দীপাবলি বা দেওয়ালি উৎসব। এই ঐতিহ্যবাহী দেওয়ালি উৎসবও আজ সার্বজনীন রূপ পেয়েছে। শারদোৎসবের সময় থেকেই আপামর জনগন দেওয়ালি উৎসবের দিন গুনতে থাকে। এ যেন অন্য ধরণের আনন্দের স্বাদ। অন্ধকার থেকে আলোয় উত্তরণের এই মহান উৎসবে সামিল হন জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল অংশের ধর্মপ্রান মানুষ।
মন্দির নগরী আজ সেজেছে উৎসবের টানে। আসলে যে কোন মেলাই মানুষকে মেলায়। মিলনের আকাঙ্খাই মানুষকে টেনে আনে এক জায়গায়। তাতে কোথাও থাকে ধর্মীয় উৎস, কোথাও থাকে সাংস্কৃতিক উম্মাদনা। তবে সবখানেই এক শুভবোধ মানুষকে পরিচালিত করে। উদয়পুরের দীপাবলি মেলায় ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সমন্বয় ঘটেছে বলেই দলে দলে মানুষ ছুটে আসেন। এই আলোর উৎসবে তারা নিজেদের জীবন, মানবের জীবন থেকে অন্ধকার দূরীকরণের কামনায় উদ্বেল হন।
ত্রিপুরাসুন্দরী মন্দিরের সঙ্গে একাধারে জড়িয়ে আছে ইতিহাস, কিংবদন্তী, ধর্মীয় উপাদান এবং এ রাজ্যের কৃষ্টি কলার সংমিশ্রন। একান্ন পীঠের অন্যতম উদয়পুর ত্রিপুরেশ্বরী মন্দিরের প্রধান উৎসব দেওয়ালি।এখানে প্রতিষ্ঠিতা দেবী শক্তি। কিংবদন্তি আছে যে স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে মহারাজা ধন্যমাণিক্য চট্টল থেকে আনিয়েছিলেন সাড়ে তিন হাত উঁচু কষ্টিক পাথরে খোদাই দেবীমূর্তি। স্থাপিত করেছিলেন কুর্ম পীঠের বিষ্ণু মন্দিরেই ১৫০১ সালে, ১৪২৩ শকাব্দের ২৮ ফাল্গুনে। কল্যান মাণিক্যের সময়ে পাওয়া চন্ডীমূর্তিও পূজিত হন এখানে।পুরান কাহিনী, ইতিহাসের সূত্র ধরে নানা লোককাহিনী জড়ানো আছে ত্রিপুরেশ্বরীকে নিয়ে। ধর্মপ্রান মানুষ ছুটে আসেন, আসেন পর্যটকরাও।
সবুজ নৈসর্গিক পরিমন্ডলে, অপরূপ মন্দির ভাষ্কর্যের আকর্ষনে, কল্যান মাণিক্যের রাজত্বকালে খনন করা্ দীঘির স্বচ্ছ জলে খেলা করে বিরল প্রজাতির কচ্ছপ। রয়েছে হরেক রকমের মাছের জল বিহারের নয়নাভিরাম দৃশ্য। সামান্য দূরে ভূবনেশ্বরী মন্দির – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অমর সৃষ্টি রাজর্ষি ও বিসর্জনের প্রানভুমি। এখানে উচ্চারিত হয়েছিল চিরন্তন মানব মনের জিজ্ঞাসা –‘এত রক্ত কেন? প্রবল প্রতাপাণ্বিত রঘুপতি ক্ষমতার দম্ভের পরিবর্তে দীক্ষিত হয়েছিলেন ত্যাগের মন্ত্রে। কাছাকাছি ছড়িয়ে আছে অনেক মন্দির,স্বচ্ছ সলিলা সরোবর এবং অবশ্যই লাবণ্যময়ী গোমতী। এসবের আকর্ষনে দুর্বার মানুষ তাই ছুটে আসেন বার বার।কিন্তু দেওয়ালি মেলা অনন্য। দীপে দীপে যেমন দ্বিপাণ্বিতা, মানুষে মানুষে তেমনি মেলা। যে যে উদ্দেশ্যেই আসুন সবারই পরিচয় শুধুই মানুষ, কোন ভেদাভেদ নেই। নেই কোন দ্বন্দ, আছে শুধু প্রানভরা আনন্দ।
আগরতলা শহর থেকে প্রায় ৫৫ কি: মি: দক্ষিনে মাতাবাড়ি ত্রিপুরেশ্বরী মন্দির।আম্র কাননে আচ্ছাদিত কূর্মাকৃতি এই মন্দির প্রঙ্গনটি আলো আর আলোতে উচ্ছাসিত হয়ে উঠেছে। পীঠস্থান হিসেবে পরিচিত বলেই মাতাবাড়ি শুধু এ রাজ্যের মানুষের একার নয়, সারা দেশের জনগনের কাছে এক পবিত্র অন্যতম তীর্থভূমি। দেওয়ালির এই পবিত্র দিনে দেবালয় প্রঙ্গনে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নয়, পূন্যার্থীরা ছুটে আসেন বহি:রাজ্য থেকেও। এই দেবালয় প্রাঙ্গন পরিনত হয় বিশাল জনসমুদ্রে। দীপাবলির আলোর রোশনাই আর অগণিত মানুষের কলগুঞ্জিনে ভরে উঠে বিস্তীর্ন অঞ্চল । জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলে মিলিত হন এই মহাতীর্থে। সব ভেদাভেদ ঘুচে সৃষ্টি হয় মানব মৈত্রীর এক মহান উপলব্ধি। দেওয়ালি উৎসব আমাদের জীবন আরও আলোকিত করুক, মনের কোনে লুকিয়ে থাকা সব দীনতা,মলিনতা মুছে দিয়ে আলোয় ভরে থাক দিগন্তের শেষ পরিসীমা। এইটুকুই হোক সকল মানুষের আবেগদীপ্ত উচ্চারন।