Paramita Gharai:
ProMASS: Nov 16, 2016:
ছোটবেলায় বাজাতেন বাঁশী । আর বড় হয়ে হলেন গীতিকার ,সুরকার। পাশ্চাত্য মার্গসঙ্গীত থেকে ভারতের বিভিন্ন মার্গসঙ্গীত,লোকগান –সব ক্ষেত্রেই অবাধ বিচরণ তাঁর।রবীন্দ্রোত্তর পর্বে তাঁর হাত ধরে রচনা হয়েছে অনেক কালজয়ী বাংলা গান। পরে হিন্দী গানের দুনিয়াতে ও ভারতবর্ষের প্রায় সমস্ত ভাষাতেই সুরের তুফান তুলেছেন তিনি। তিনি সলিল চৌধুরী। বঙ্গবাসী কলেজে পড়ার সময় কিছুদিন তাঁকে ক্যানিং হোস্টেলে কয়েকদিন থাকতে হয়েছিল। সেখানেই তাঁর বামপন্থী রাজনীতির হাতেখড়ি।পরবর্তী জীবনে মাটির মানুষদের মধ্যে থেকেই কাজ করেছেন। হয়েছিলেন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যও। ভারতীয় গণনাট্য সংঘে তাঁর আসা সজল রায়চৌধুরীর হাত ধরে। সোনারপুরের কমিউনিস্ট নেতা খগেন রায়চৌধুরী (যিনি খেপুদা নামে পরিচিত) সলিল চৌধুরির গান রচনার ক্ষমতার পরিচয় পেয়ে তাঁকে সাংস্কৃতিক সাংগঠনিক কাজে যুক্ত করেন। ফলস্বরূপ বাংলা আধুনিক গানে সূচিত হল নতুন অধ্যায়।

কৃষকদের গান, বন্দীমুক্তির গান বা শহীদ স্মরণের গানগুলো পরাধীন দেশে পঞ্চাশের দশকে জনপ্রিয় হয়েছিল। এরমধ্যে‘কোনো একগাঁয়ের বঁধূ’ ,‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে’,‘এইদেশ এইদেশ আমার এই দেশ’,‘কারার দুয়ার ভাঙো’,‘শহিদ সাথি গো’ গানগুলো উল্লেখ করা যায়।দেশমাতৃকার উদ্দেশ্যে রচিত গানগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘ধন্য আমি জন্মেছি মা’,‘দূর নয় দূর নয় দিগন্ত দূর নয়’ ইত্যাদি গানগুলো।সলিল চৌধুরি একবার আন্দাজ করে বলেছিলেন তাঁর রচিত গণসংগীতের সংখ্যা প্রায় ষাট। গুণে দেখা গেছে গণসংগীত লেখার উদ্দ্যেশে লেখা গানের সংখ্যা সত্যিই ষাট। কিন্তু অনেক গান শুধুমাত্র লেখার গুনেই গণসঙ্গীতের মর্যাদা পায়। তাঁর গণসঙ্গীতগুলোকে বিভিন্ন পর্যায়ে ভাগ করেছেন গবেষক সমীরকুমার গুপ্ত। বিপ্লব–বিদ্রোহের গান (আমার প্রতিবাদের ভাষা,এ যে অন্ধকারে),সাম্যবাদের গান (আর দূর নেই দিগন্ত দুর নেই),সংগ্রামের গান(ঢেউ উঠছে),যুব জাগরণের গান(ও আলোর পথযাত্রী, ধিতাং ধিতাং বোলে),ব্যাঙ্গাত্মক গান(ওহে নন্দলাল) প্রভৃতি রয়েছে।
বাবা জ্ঞানেন্দ্রনাথ ছিলেন ডাক্তার।আসামে চা বাগানে চাকরী করতেন। ছিলেন পাশ্চাত্য সংগীতের অনুরাগী।ছোটো থেকেই তাই পশ্চিমি গানের সুর যেমন তাঁর মনে পাকাপাকি জায়গা করে নিয়েছিল তেমনি আসামের লোকজীবনের গানও তাঁর মনে দাগ কেটেছিল।আসাম থেকে তাঁকে পড়াশোনার জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল কলকাতার সুকিয়া স্ট্রীটে,জ্যাঠামশায়ের বাড়িতে। সেখানে বসত অর্কেষ্ট্রার আসর। ছোটোকাকা নিখিল চৌধুরির ছিল অর্কেষ্ট্রার দল। মাত্র এক বছর ছিলেন সুকিয়া স্ট্রীটে।ছোট্ট সলিল ঐ এক বছরেই রপ্ত করেছিলেন বিভিন্ন রকম বাজনা বাজানো। এমনকি উঁচু টুলে বসে পিয়ানোর রিডে সাবলীল গতিতেই চলত তাঁর আঙুল। হারমেনিয়াম,বাঁশী ,তবলা, পিয়ানো,ক্ল্যারিয়নেট ,এস্রাজ সহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রে অবাধ বিচরণ,পাশ্চাত্য ও ভারতীয় মার্গ ও লোকসঙ্গীতের সহজাত আত্তীকরণ ভারতীয় সঙ্গীত জগতে সলিস চৌধুরিকে উঁচু আসনে বসিয়েছে। অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি,সামাজিক কাঠামো,পারিবারিক অনুপ্রেরণা,আর্থিক অবস্থা,ব্যক্তিগত রাজনৈতিক মতাদর্শ, সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল।
সম্ভবত রবীন্দ্রপরবর্তী যুগের শ্রেষ্ঠ সুরকার ও গীতিকার সলিল চৌধুরি। সলিল চৌধুরির গানে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের সুর। কিম্তু কখনই একঘেয়ে হয়ে ওঠেনি। তাঁর সুরারোপিত প্রতিটি গান স্বাতন্ত্র্যের দাবী রাখে। কখনো কখনো একই গানের মধ্যে তাল,সুর,লয়ের বিভিন্নতা ,কর্ডের সুনিপুণ প্রয়োগ গানগুলোর গতিকে উদ্দাম, প্রাণময় করেছে। তাই গণসঙ্গীত শুধু কমিউনিস্ট পার্টির কুক্ষিগত সম্পদ হয়ে থাকে নি ,বরং সাধারণ মানুষের কাছে আজও আকর্ষণীয় গাঁয়ের বঁধূ, ধিতাং ধিতাং বোলে,পথে এবার নামো সাথী, নন্দলাল–দেবদুলাল। অন্যান্য কবি ও গীতিকারদের লেখা কথার ওপর তাঁর সুর দেওয়া জনপ্রিয় গানগুলো হল অবাক পৃথিবী, রানার ,পাল্কির গান। সলিল চৌধুরির গণসঙ্গীতের সুর ও কথা রাজনৈতিক চিন্তার সীমাবদ্ধতা ও আবেদন ছাপিয়ে সাধারণ মানুষের সাংস্কৃতিক চেতনাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। কাব্য ও ভাবপ্রধান রবীন্দ্রসঙ্গীত,জটিল শাস্ত্রীয় সঙ্গীত,চটুল কবিগান ও খেমটা,থিয়েটারের গান,ভক্তিমূলক রামপ্রসাদী গান থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন রসের স্বাদ বাঙালীর সঙ্গীতরসনাকে পরিবেশন করলেন সলিল চৌধুরি বাংলার সংস্কৃতি যখন কল্লোল যুগে পথ হাঁটছে। স্বভাবকবি ও গায়ক সলিল চৌধুরি গান রচনা করেছেন যখনতখন। কখনো বা সময়ের প্রয়োজনে। বিড়ি শ্রমিকদের মাঝে বসে আন্দোলনের তাগিদেই গান রচনা করেছেন। পরে তিনি নিজেই ভুলে গিয়েছেন সেই গান। এভাবে হারিয়ে গেছে অনেক গান। বিশেষত শ্লোগানভিত্তিক গানগুলো বেঁচে থাকেনি।

ADVERTISEMENT
ADVERTISEMENT