Paramita Gharai
ProMASS: Jan 16, 2017:
উপজাতি মানুষের ঢল নেমেছে উদয়পুরের রাস্তায়। নিজেদের গোষ্ঠীর পোষাকে সুসজ্জিত হয়ে খাম(মাদল), সুমু(বাঁশী)বাজিয়ে তারা আজ রাজধানীর পথে। হাতে তাদের মিলাম(তরবারি), বালাই(বাঁশের অস্ত্র)। রাজার নিমন্ত্রণে অনেক দূরের পথ তারা হেঁটে এসেছে পাহাড়ের গা বেয়ে, জঙ্গল–নদী উজিয়ে। আজ যে ‘হসম ভোজন’। বিজয়া দশমীর দিনে রাজার বাড়িতে ভোজসভা। ভোজসভার শেষে রাজার দেওয়া উপহার নিয়ে ফিরে যাবে তারা। ফিরে যাবে সবুজ ঘেরা ঝুম চাষের পাহাড়ে। যেখানের মেয়েরা ঘরের কাজে , পোশাক বানানোয় ও রান্নায় অতি নিপুণ;যেখানের মেয়েরা নাচগান ও রূপচর্চায় পারদর্শী; যেখানের মেয়েরা হাসিতে ভুলিয়ে মায়া জাল বিছিয়ে পুরুষকে ‘ভেড়া’ করে রাখে। এরা সবাই ‘মায়ানী দেশ’এর বাসিন্দা।
ত্রিপুরার উপজাতিদের রূপকথা, ছড়া, পুরাণ ,প্রবাদে ত্রিপুরার অপর নাম ‘মায়ানী দেশ’ অর্থাৎ যাদু–সূর্যের দেশ।
উঁচুনীচু অগভীর অপ্রশস্ত উপত্যকা সবুজ ঘন জঙ্গলে ঢাকা। তার মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে ছোটো–বড়ো গভীর– অগভীর নদী। এসবের মাঝেই ইতিউতি ছড়িয়ে আছে প্রাচীন যুগের সভ্যতার আকর। যাদু–সূর্যের আলোয় কখনও তা চকচক করে ওঠে ,কখনও বা আদিম অরণ্যের অন্ধকারে হারিয়ে যায়। প্রত্নতত্ত্বের ঝুলিতে সমগ্র ত্রিপুরা জুড়ে উপজাতি–হিন্দু–বৌদ্ধ এই তিন মিশ্র সংস্কৃতির চিহ্ন। কুমারী প্রকৃতির কোলে ইতিহাসের সঙ্গে উপকথা জড়াজড়ি করে আছে এখানে। সব মিলিয়ে ত্রিপুরা তাই মোহময়ী, রহস্যাবৃতা।
আগরতলা থেকে ১০০ কিলোমিটার বা উদয়পুর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে ইতিহাসের সাক্ষ্য নীরবে বহন করে চলেছে ছোট্ট গ্রাম পিলাক। গ্রামের পেছনে অতন্দ্র পাহারায় টাক্কাতুলসী পাহাড়। বৌদ্ধ দর্শণ অনুযায়ী ‘পিলা’ কথার অর্থ ‘এগিয়ে আসা’। গ্রামের মধ্যে বহুবছর ধরেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে বেলে পাথরের নানা দেবমূর্তি। ১৯৯৫ সালে খনন কার্য শুরু হয় ভারতীয় পুরাতাত্ত্বিক বিভাগের অধীনে। শ্যামসুন্দর টিলায় মাটির ঢিবি সরাতেই বের হয়ে এল প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। জ্যামিতির নিঁখুত নকশায় বারোটা দেওয়াল আর আটকোন বিশিষ্ট মন্দিরটি । কারোর মতে এটি বৌদ্ধস্তূপ। পুজোর বেদী একেবার মন্দিরের কেন্দ্রস্থলে। গোলাকার পুজোর ঘরের চারদিক থেকেই প্রবেশ করা যায়। পাথরের বেদীটির ওপর ক্ষয়ে যাওয়া একটা পাথর।সেটি একটা অবয়বের পা এর অংশবিশেষ।হয়তো অবয়বটি পূজিত হতো। গাছের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড় করানো সূর্যমূর্তি। আরো দুটো ভাস্কর্য্যের দেখা মিলল এখানে। তার মধ্যে একটি বিখ্যাত ‘অবলোতিকেশ্বর’ । ভেঙে যাওয়া মন্দিরের দেওয়ালে ছিল টেরাকোটার কারুশিল্প। এর সাক্ষ্য এখনও কিছুটা বয়ে চলেছে বিস্মৃতির স্তূপ থেকে উঠে আসা কিন্নর–গন্ধর্ব–বিদ্যাধর–গাছ লতাপাতা–পশুপাখির ভাস্কর্য্য। পাশাপাশি বৌদ্ধ কৃষ্টির ধারায় জায়গা করে নিয়েছে অর্ধমানব,অর্ধপশু ,পদ্মকোষ মন্দিরের গায়েই। পুরাতত্ত্বিকরা বলেন বাংলাদেশের ময়নামতীতে ধ্বংসস্তূপ থেকে পাওয়া স্থাপত্য–ভাস্কর্য্যের সাথে পিলাকের পুরাকীর্তির আশ্চর্য মিল। কুমিল্লার ময়নামতী ছিল বৌদ্ধধর্ম ও দর্শন চর্চার বড়কেন্দ্র। সেখান থেকে বক্সানগর হয়ে বৌদ্ধসন্ন্যাসীরা যেতেন পিলাক । সেখান থেকে সাব্রুম হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের পথ ধরতেন তাঁরা।
একটু এগিয়েই পিলাক বাজার। বাজারের পাশেই ঠাকুরাণী টিলা। ১৯৯৮–৯৯ সালে স্তুপীকৃত মাটির স্তর সরাতেই পাওয়া গেল আরও পুরাকীর্তি। চাতালের নীচে রাখা দশফুট উচ্চতার সূর্যমূর্তি। গ্রামের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে গণেশ,শেষনাগসহ আরো মূর্তি । বাড়ির দেওয়াল ঘেষে, ধানজমির মাঝে জেগে আছে আরো ঢিবি, সেগুলো এখনও খননের অপেক্ষায়। এছাড়া আশপাশের গ্রামগুলোতেও ছড়িয়ে আছে এমন অনেক নিদর্শণ।
মুহুরীরপুরে সাড়ম্বরে পূজা হয় আঠারো হাতবিশিষ্ট দেবী রাজরাজেশ্বরীর। সঙ্গে আছে সূর্যদেব,মঙ্গলচন্ডী,গণেশ। মহারাজা বীরবিক্রম মানিক্যের আমল থেকেই এখানে এই চার দেবদেবী অধিষ্ঠিত। এছাড়া পাওয়া গাছে কিছু সোনা ও রূপোর মুদ্রা। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে এই মুদ্রাগুলো সপ্তম থেকে ত্রয়োদশ শতকের । এখানে ভারতীয় পুরাতাত্ত্বিক বিভাগের অধীনে গড়ে উঠেছে সংরক্ষণশালা, যদিও তা সাধারণের জন্য এখনও রুদ্ধ। এখানে রক্ষিত আছে ধ্বংসস্তূপ থেকে পাওয়া স্ফটিকের শিবলিঙ্গ সহ অনেক পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শণ। বিষ্ণুমূর্তি আবার আগরতলা রাজ্য যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।

এতো গেল ইতিহাস আর পুরাতত্ত্ব। লোককথা অন্য গল্প বলে। উপজাতি মগ সম্প্রদায়ের মতে পিলাকে ছিল প্লেং রাজার রাজত্ব। রাজা ছিলেন বৌদ্ধ। পাশে ছিল কোলা রাজ্য। প্লেংরাজা কোলা রাজ্যে বেড়াতে গিয়ে সেখানকার বৌদ্ধবিহার ও বিগ্রহ দেখে মুগ্ধ হন। কোলা রাজাকে শ্বেতহস্তী উপহার দেন প্লেংরাজা। পরিবর্তে প্লেং রাজা একজন দক্ষ ভাস্করকে পাঠান কোলা রাজার কাছে। সে একে একে গড়ে তোলে এইসব মূর্তি আর ভাস্কর্য। প্লেং রাজকন্যা মুগ্ধ হন শিল্প ও শিল্পীকে দেখে। তরুন ভাস্করেকে মন দিয়ে ফেলেন তিনি। আর ভাস্করের হাতুড়ির ঘায়ে পাথরের বুকে জেগে উঠল রাজকন্যার প্রতিমূর্তি। টনক নড়ল রাজার। জানতে পারলেন রাজকন্যা অন্তসত্ত্বা। শিল্পীর দুহাত কেটে নেওয়া হল রাজার আদেশে। খবর পেয়ে কোলা রাজা যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। তছনছ হয়ে গেল প্লেং রাজ্য। লুঠ হল সম্পদ। প্লেং রাজা পালিয়ে গেলেন। যাবার সময় তাঁর সৈন্যরা কেটে দিয়ে গেল পিলাকছড়া নদীর বাঁধ। জলের তোড়ে ভেসে গেল কোলা রাজার সৈন্যরা। প্লেং রাজকন্যা এই জলস্রোতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। টাক্কাতুলসী পাহাড়ের কোলে সবুজ বনানী ঘেরা ছোট্ট গ্রাম পিলাকে আজও প্রতিধ্বনিত হয় এই প্রেম কাহিনী।