।। মানস পাল।।
কথায় বলে, “মূর্খ লোকের প্রধান হাতিয়ার হলো অশ্লীল বাক্য”। কিন্তু কোন শব্দ বা বাক্যবিন্যাস ‘শ্লীল’ অথবা কোন শব্দ ‘অশ্লীল’ তা কিভাবে এবং কোন মাপকাঠিতে ঠিক হবে সেটা গুরুত্বপূর্ণ। পাঠকের বা শ্রোতার ব্যক্তিগত অবস্থান এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা নেয়। অনেক সময় কেন, সব সময়ই ‘প্রেক্ষিত’ ও পরিস্থিতির এর উপর নির্ভর করে। সাহিত্যের ইতিহাসে অনেকসময় অনেক সাধারণ্যে কথিত অশ্লীল শব্দ পরবর্তী ক্ষেত্রে মান্যতা পেয়েছে শ্লীল শব্দ হিসাবে। অনেক সময় তথাকথিত অশ্লীল শব্দ বক্তব্যের সঠিক ভাব প্রকাশে সাবলীল, যা শ্লীল শব্দে সম্ভব হয় না, বা অর্থের প্রকাশে খানিক পরিবর্তন ঘটায়।
বক্তা-র সামাজিক, পারিপার্শিক, অর্থনৈতিক ইত্যাদিকার অবস্থান তার শব্দ প্রয়োগ অনেকাংশেই নির্ধারিত করে। গ্রামীণ মানুষের অনেক শব্দ হয়ত শহুরে মানুষের কাছে অশ্লীল মনে হতেই পারে, কিন্তু সেই গ্রামীণ মানুষটি-র কাছে তার প্রয়োগ সচেতন ভাবে অশ্লীল নয়।
আবার অনেক সময় আমরা না বুঝে না জেনেই কোনো শব্দ বা বাক্যকে অশ্লীল বলে আখ্যায়িত করি। একটি উদাহরণ দেই : আমাদের একটি খুবই চালু গালি আছে – ‘পুঙ্গির পুত’। এটির ব্যবহার আমি গালি হিসাবেই সুনীল গাঙ্গুলির একটি গল্পে বহু আগে পড়েছিলাম দেশ পত্রিকায়। এই বাক্যটি সাধারণ্যে অত্যন্ত অশ্লীল হিসাবেই পরিগণিত। কিন্ত এটির উৎস টি কি ?
আসলে বার্মিজ ভাষায় পুঙ্গি মানে বুদ্ধিস্ট মংক। এখন যেহেতু পুঙ্গি রা সংসারী নন, তাঁদের সন্তানও হয় না। ফলে ‘পুঙ্গির পুত’ মূল অর্থে –এক অস্তিত্বহীন চরিত্র। এমন হতে পারে যে প্রাচীন বাংলার সঙ্গে যখন বার্মার যোগাযোগ ঘনিষ্ঠ ছিল তখন লুঙ্গির মত পুঙ্গিও বার্মা থেকে চলে এসেছে গ্রাম বাংলার ব্যবহারিক জীবনে। আমি সঠিক তো জানি না, আন্দাজে বললাম।
আরেকটি উদাহরণ। সিলেটি, বা এখন সিলেটি কেন অনেকেই ‘আড়ুয়া’ বলে একটি শব্দ ব্যবহার করেন। এটি আপাতঃ দৃষ্টিতে শ্লীল শব্দ নয়। কিন্তু এর ব্যুৎপত্তি-র সঙ্গে গ্রামীণ জীবনের একটি সম্পর্ক রয়েছে। আপনারা অনেকেই দেখেছেন গ্রামে ধানের খড় একজায়গায় স্তুপ করে মাচান বাঁধা হয়। ওই মাচানের নীচে বেশ কিছুদিন পর ধান গাছ জন্মে, ধানও দেখা যায়। কিন্তু ওই ধানে চাল থাকে না। ওই ধান কোনো কাজে লাগে না -না খাবার হয়, না দেবতা পূজার ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়. এই ধান – দেখতে ধান কিন্তু আসলে ধান তো নয়, কোনো কাজের নয়। এবং এটি ‘আ -রোয়া’ অর্থাৎ এই ধান গাছ রোয়া হয় নি। এখানে গ্রামীণ খেটে খাওয়া ধান জমি এসবের সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষ কোনো এক নিষ্কর্মা বেবাট আহাম্মক কে ওই ধানের সঙ্গে তুলনা করছেন, — একটি সম্পর্ক স্থাপন করছেন , যা গ্রামীণ জীবনের স্বাভাবিক চিন্তনের প্রতিফলন।
অনেক সময় সঠিক শ্লীল শব্দের অনুপস্থিতে অশ্লীল বা কথ্য শব্দ ব্যবহার হয় – যেমন বোম্ব -এটির অপভ্ৰংশ হিসাবে বাংলায় বোমা বলা হলেও বাংলার নিজস্ব কোনো শব্দ নেই ( পটকা আসলে ইংলিশ ক্র্যাকার -ঠিক বোম্ব নয় যা ছুঁড়ে মারা হয়). কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের অপরাধ জগতে এর একটি প্রতিশব্দ আছে যা অশ্লীল বা স্ল্যাং — পেটো। তেমনি পুলিশের রয়েছে একশ্রেণীর চর দের জন্য ‘খোঁচর’ .. যতটুকু মনে পড়ছে এ ধরণের ভাষা/ বাক্য। শব্দ নিয়ে একটি বই ও লেখা হয়েছে। .
ইংরেজিতে কথ্য ভাষায় অশ্লীল বা স্ল্যাং শব্দের যেমন প্রাচুর্য তেমনি সাহিত্যেও এর ব্যবহার প্রচুর। জেমস জয়েস স্ল্যাং – বা অন্যভাবে বললে সংরক্ষণশীলদের কাছে বর্জিত শব্দ – ব্যবহারে কোনো দোষ পান নি আবার জোসেফ কনরাড এর বিরুদ্ধে। আসলে জয়েস এর মতো লেখক নিজেও প্রচুর পরিমানে এগুলি নিজ নিজ স্টাইলে ব্যবহার করেছেন, নিজে কিছু বানিয়েছেনও। লুই ল্যামুর এর কাউবয় উপন্যাস তো অ-শ্লীল কথ্য শব্দে ভরপুর। সত্যি বলতে, আমার মনে হয় ওই শব্দ গুলি না থাকলে কাউবয়দের উষর পটভূমিতে সংঘাতপূর্ণ অনিশ্চিত দৈনন্দিন জীবন, তাঁদের জীবন দর্শন, তাঁদের সার্বিক চরিত্রই ভালো করে বোঝা যাবে না। পাঞ্জাবিদের যে কমন গালি বা অশ্লীল বাক্যব্যবহার তাতে তাঁদের দিলদার জীবনস্পৃহাই প্রতিফলিত হয় বলে মনে করি। তাঁদের অশ্লীল শব্দ ব্যবহারে ভালোবাসার প্রকাশ সহজবোধ্য।
এক দেশের ভাষা আরেক দেশের কথায় অশ্লীল হয়ে যায়। যাঁরা ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছাত্রী তাঁরা জানেন অনেক আমেরিকান ইংরেজি শব্দ ব্রিটিশদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়, অথবা এগুলির মানে ও ভিন্ন ভিন্ন। বিস্কুট -কুকিজ , এডভোকেট -সলিসিটর।
আবার অনেকসময় আমরা অজান্তেই কোনো কোনো শব্দ ব্যবহার করি যা সঠিক না হবার ফলে অশ্লীল বলে বিচার্য হতে পারে। যেমন ইংরেজি ‘আন ওয়েল’ … একদম যাকে বলে ‘গোয়িং বাই দ্য বুক’ হলে কোনো পুরুষ মানুষের ক্ষেত্রে এই শব্দটি ব্যবহার যোগ্য নয়। পুরুষ মানুষ ‘সিক’ হতে পারেন, ‘ইল’ হতে পারেন, কিন্তু ‘আন ওয়েল’ হন না। মহিলারা হন কোনো এক বিশেষ সময়ে। আবার এই যেমন ধরা যাক – ‘সিক’. …এখন কোনো একজন সিক বললে — (he is sick) –এটি শ্লীলতা হারায় না। কিন্তু আমি যদি বলি – I am ‘sick’ with that guy – এটি এবার শ্লীলতা হারালো। ব্লাডি শব্দটি অশ্লীল নয়. কিন্তু প্রয়োগ প্রেক্ষিত-এ এটি অশ্লীল।
আজকাল LoL , RoFl ..এই শব্দগুলি ভার্চুয়াল মিডিয়াতে খুব ব্যবহার হচ্ছে, এগুলি অনেকেই অশ্লীল মনে করেন, কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে কোনো অশ্লীলতা পাই না। আবার অনেকে কারো মৃত্যুতে যখন RIP লেখেন এতে অশ্লীলতা পাবার কোনো কারণ নেই। কিন্তু আমি ব্যক্তিগত ভাবে এটিকে ‘অশ্লীল’ মনে করি এই কারণে যে কোনো মৃতের প্রতি সম্মান জানাতে হলে পুরো শব্দটি –‘ রেস্ট ইন পিস ‘ লেখার মানসিকতা থাকা দরকার। ওই যে বলা হলো –প্রেক্ষিত।
অনেক সময় আবার কিছুটা অশ্লীল বাক্য বিন্যাস অত্যন্ত intelligent ভাবে ব্যবহার করার সুযোগ থাকে এবং তা এমন একটি চিত্র উপস্থাপন করে যা বোধহয় শ্লীল বা গ্রহণীয় ভাষায় তেমন ভাবে সম্ভব নয়। He looks like a boy in a topless bar ….Sachin hit the ball so high that it may bring down air hostess with it.. এ দুটি আমি সিধুর কাছ থেকে নিলাম। বাক্য দুটি খুবই পবিত্র এরকম হয়তো নয়, কিন্তু পরিস্থিতি চিত্রায়নে এর চেয়ে ভালো প্রয়োগ আপাততঃ মনে আসছে না। ঠিক তেমনি একটি ক্ষেত্রে আমি নিজে ব্যবহার করেছিলাম এক রাজনীতিবিদ দুর্নীতির কারণে জেলে যাবার পর — without him ( the politician) Indian politics is like pornography without sex….এতে অনেকে আমাকে ইনবক্সে লিখেছিলেন –ভালো বলেছো বটে তবে একটু অশ্লীল হয়ে গেলো কিনা ?
গালি গালাজ-বা ( expletives)-কে বলা যেতে পারে বাই এসেন্স — অশ্লীল। কিন্তু ক্যাপটেন আর্চিবল্ড হ্যাডক কে তাঁর বিখ্যাত সেই সব গালি ( expletives) ছাড়া কি চিন্তা করা যায় ? না প্রিয় হ্যাডক আর হ্যাডক থাকেন?
লেখাটি বেশ বড় হয়ে গেলো। শেষ করার আগে মনে হয় এখানে ন্যারাটিভ আর ডায়ালগ-এর বিষয়টি আলোচ্য হতে পারে। অনেকেই মনে করেন ন্যারেটিভে সর্বজন গ্রাহ্য বাক্যবিন্যাস উচিত কিন্তু ডায়লগ-এ প্রয়োজনে চরিত্র চিত্রায়ন সঠিক করতে এবং বক্তব্যের মূল আঁধারে যেতে হলে কখনো কখনো অশ্লীল শব্দের প্রয়োগ বাঞ্ছনীয় হয়ে পড়ে বইকি।