অনিকেত
লিখবো, লিখবো করে গড়িমসি করলাম। আমি লেখার আগেই একজন কলকাতার হারিয়ে যাওয়া পাড়া নিয়ে লিখে ফেল্লেন। এই করবো, করবো ভাবনায় মশগুল না থেকে, কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার উপদেশ যুগ যুগ ধরে মহাত্মারা দিয়ে গেছেন। ছোটবেলা থেকে আমিও শুনে আসছি রাবনের স্বর্গ-সিঁড়ি বানানোর গল্প। এতো শুনেও শিক্ষা হল কই? কাল লিখবো ভেবে ভেবে পাক্কা ১৫দিন কাটিয়ে দিলাম। সেই ফাঁকে সাবেক লেক মার্কেট এবং ডোভার লেন হারিয়ে যাওয়ার কথ্য-কাহিনী পত্রিকায় বেড়িয়ে পড়লো। আমার ইচ্ছে ছিল সাবেক গড়িয়া নিয়ে লেখার। প্রায় ২৫-৩০ বছর আগের গড়িয়ার কথা, যখন গড়িয়ার মেইন রোডে শেয়াল-কুকুরের লুকোচুরি খেলা শুরু হতো সন্ধ্যে নামলেই। ট্যাক্সিওয়ালাকে গড়িয়া যাবার কথা বললেই, কোন কথা না বলে পাঁই পাঁই করে ছুট লাগাতো। কিন্তু ইচ্ছে পাখিটা ডানা মেলে নি । চুপটি করে ডালে বসে বসে ভেবেই আকুল হয়েছে, তাই শেষপর্যন্ত আর লেখা হলো না।
গড়িয়ার অবস্থা গত প্রায় আড়াই দশকে কতটা পাল্টেছে, সেই ইস্যু আজ থাক। বরং দেখা যাক গড়িয়ার ৫-৬ নং বাস ডিপোর হাল কেমন। গত আড়াই বা তিন দশক আগের একটা জিনিস আজ হারিয়ে গেছে। এই ‘জিনিস’টা একসময় শিশু মনে অনাবিল আনন্দধারা বইয়ে দিতো। দোতলা বাস। সবার উপর দিয়ে সেইসময়ের কলিকাতাকে দেখতে দেখতে চলার অনুভূতি সত্যিই অনবদ্য ছিল। বিশেষ করে পূজোর দিনগুলিতে বাবা-কাকা-মামাদের সাথে দোতলা বাসে চড়ে পূজো দেখার মধ্যে একটা অদ্ভুত রোমাঞ্চ ছিল। বয়সটা তখন কম। তাই সময়কে হার মানিয়ে গতির জন্য আবেগ বিসর্জন দেওয়ার দরকার ছিল না। হেলতে দুলতে চলতে থাকা দোতলা বাসে চড়ার আনন্দেই মশগুল থাকতাম। অনেক বছর পর্যন্ত এই দোতলা বাস আধুনিকতার অন্যতম শর্ত সময়-এর সাথে পাল্লা দিয়ে টিকে থাকার লড়াই করেছে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় নি। তা না হোক, কিন্তু কলিকাতার সামাজিক জীবনের সাথে দোতলা বাসের বহু বছরের নিবিড় যোগ তো ছিল, একথা অস্বীকার করা যায় না। অথচ, কালের পথ ধরে, প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যেতেই দোতলা বাসগুলিকে ঘুমটি থেকে কোথায় হাপিস করে দেওয়া হল, কে জানে।

গড়িয়া বাস ডিপোতে খোঁজ নিয়েছিলাম, কোথায় আছে দোতলা বাসগুলি? উত্তর মেলে নি। নিদেন পক্ষে একটা দোতলা বাসকে কী সাজিয়ে গুছিয়ে সংরক্ষণ করা যেতো না, স্রেফ প্রদর্শনীর জন্য? যদি একটাও বাস রাখা হতো, তাহলে অতীত থেকে বর্তমানে উত্তরণের মাঝে হারিয়ে যেতো না প্রাক্তন শিশুদের প্রিয় দোতলা বাস। আজকাল বাচ্চারা ইন্টারনেটে দোতলা বাস দেখে বটে, কিন্তু এখনকার এ সি বাসের কোলকাতার সাথে অতীতের দোতলা বাসের কলিকাতার আত্ত্বিক যোগাযোগ দৃঢ়তর করতে অন্তত: একটা লাইভ মডেল কী রাখা যেতো না? হয়তো এখনো সুযোগ আছে, কোন ঘুমটিতে যদি দোতলা বাস থেকে থাকে, তাহলে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হোক না। মডেল দেখেই না হয়, আমরা নষ্টালজিয়ায় ভেসে যেতাম হারিয়ে যাওয়া আনন্দের দিনগুলিতে।