Paramita Gharai: Oct 18, 2016
ADVERTISEMENT
আশ্বিন মাস শেষ। সন্ধ্যার হিম হিম হাওয়া বার বার জানান দিচ্ছে শরতের বিদায় আসন্ন। কিন্তু উৎসব যে এখনও শেষ হয়নি ! অন্তত আমেজ তো এখনো কাটেনি। তাই মনের মধ্যে গুণগুনাণি উঠছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শরতের গানগুলো। ব্রাহ্মপিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমলেই তাঁদের বাড়ির দূর্গাপুজো বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু উৎসবের সামাজিক দিকটি কবি সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। যাকে তিনি বলেছেন ‘একের মধ্যে বহু’। পাশাপাশি উৎসব তো আসলে প্রকৃতির বৈচিত্রময় উপস্থিতি। রবিঠাকুরের মত প্রকৃতির সঙ্গে আত্মীয়তা আর কার ? আর পাঁচই ঋতুর মত শরতের মনোরম পরিবেশ তাঁকে মুগ্ধ করেছিল একটু বেশিই। বাইরের সাথে অন্তরাত্মার অমোঘ সম্পর্ককেই তো খুঁজে বেরিয়েছেন রবি বাউল। অনুধাবন করেছেন সারাজীবন ধরে। তাই তাঁর গানে,কবিতায়,সাহিত্যে সেই অনুভূতিই ঘুরে ফিরে এসেছে বারবার। সেখানে শারদোৎসব কখনও ধর্মের গন্ডীতে বাঁধা নেই। বাঁধা পড়েছে প্রকৃতির কাছে। প্রকৃতি মানে শুধু বহিরঙ্গ তো নয়, হৃদয়তন্ত্রীতে অনুরণন। মানে হৃদয়ে হৃদয় যোগ করা। মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে প্রকৃতি আর নরনারীর প্রেম।

‘‘নরনারীর প্রেমের মধ্যে একটি অত্যন্ত আদিম প্রাকৃতিক ভাব আছে – তাহা বহিঃপ্রকৃতির অত্যন্ত নিকটবর্তী, তাহা জল, স্থল, আকাশের গায়ে গায়ে সংলগ্ন। ষড়ঋতু আপন পুষ্পপর্য্যায়ের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রেমকে নানা রঙে রসে রাঙাইয়া দিয়া যায় ..... ।
এক একটি ঋতু যখন আপন সোনার কাঠি লইয়া প্রেমকে স্পর্শ করে, তখন সে রোমাঞ্চ কলেবরে না জাগিয়া থাকিতে পারে না।’’– এই কথা থেকেই বোঝা যায় রবীন্দ্রসংগীত ও রবীন্দ্রকাব্যে ঋতুর ভূমিকা কেন এত গুরুত্বপূর্ণ।
যে প্রকৃতি ও ঋতুর ওপর মানবজীবন সম্পূর্ণ নির্ভরশীল রবীন্দ্রনাথ তাদের সাথে আমাদের নতুন করে পরিচয় করিয়েছেন।
তাঁর গানে প্রকৃতি আমাদের অনুভূতিতে নতুন রূপে নতুনভাবে ধরা দেয় বারবার।
বাংলা ১৩১৫ সালে শারদোৎসবের জন্য লেখা ‘নান্দী’ কবিতায় পাওয়া যায়–
‘‘শরতে হেমন্তে শীতে বসন্তে নিদাঘে বরষায়
অনন্ত সৌন্দর্য্যধারে যাঁহার আনন্দ বহি যায়
সেই অপরূপ,সেই অরূপ,রূপের নিকেতন
নব নব ঋতুরসে ভরে দিল সবাকার মন।।
প্রফুল্ল শেফালিকুঞ্জে যাঁর পায়ে ঢালিছে অঞ্জলি,
কাশের মঞ্জরীরাশি যাঁর পানে উঠিছে চঞ্চলি,
স্বর্ণ দীপ্তি আশ্বিনের স্নিগ্ধহাস্যে সেই রসময়
নির্মল শারদরূপে কেড়ে নিল সবার হৃদয়।।’’
প্রকৃতির ঋতুরঙ্গশালার তৃতীয় ঋতু শরৎ। নেহাত ঋতু মাত্র নয়। যেন রক্তমাংসের চরিত্র হয়ে ধরা দেয় তাঁর গানে গানে। ঋতু পর্যায়ের গীতিগুচ্ছে শরতের ঋতুর ডালিতে আছে ৩০টি গান। ‘ক্ষণিকের অতিথি’ হল শরৎ। বর্ষা যেমন তার কোমল, ভীষণ,পেলব ,বিধ্বংসী রূপ নিয়ে রবিঠাকুরের কলমের ছোঁয়ায় হয়ে উঠেছে সুন্দরী,তেমনি শরৎ যেন ধরা দিয়েছে উদাসী হয়ে। সে অতিথি তার বেলা বইয়ে দেয়। শরতের সঙ্গেই যেন তাঁর মান অভিমান ভালোবাসার বন্ধন।
‘‘ তোমরা যা বলো তাই বলো, আমার লাগে না মনে।
আমার যায় বেলা, বয়ে যায় বেলা কেমন বিনা কারণে।।’’
অথবা
‘‘ কোথায় সোনার নুপূর বাজে, বুঝি আমার হিয়ার মাঝে
সকল ভাবে সকল কাজে পাষাণ–গালা সুধা ঢেলে–
নয়ন–ভুলানো এলে।।’’
শরতের কোনো কোনো গানে ধরা পড়েছে প্রিয় বিচ্ছেদের বেদনাও। ১৮৮৬ সালে রচনা করেন –
‘‘আজি শরততপনে প্রভাতস্বপনে কী জানি পরাণ কী চায়। ….. আজি কে যেন গো নাই,এ প্রভাতে তাই জীবন বিফল হয় গো–’’
এই গান রচনার বছর দেড়েক আগেই মৃত্যু হয়েছে প্রিয় বৌঠান কাদম্বরী দেবীর। তাঁর ‘ছেলেবেলা’ কাব্যগ্রন্থের স্মৃতিচারণে কবি এই গান প্রসঙ্গে বলেছেন–‘‘আমার কেবল মাঝে মাঝে মনে পড়ে––ঐ বারান্দার সামনেকার বাগানে মন–কেমন–করা শরতের রোদদুর ছড়িয়ে পড়েছে,আমি নতুন গান রচনা করে গাচ্ছি। ’’ কখনও ব্যাক্তিজীবন প্রভাবিত করেছে কবির প্রকৃতি চেতনাকে, আবার প্রকৃতি এসে অনায়াসে ঢুকে পড়েছে ব্যাক্তিজীবনের ওঠাপড়ায়। তাই কি শরতের বেশীরভাগ গান রচনার সময় কবি উদাসীন!
শরতের সাদা মেঘ, নীল আকাশ উদাস মনের সঙ্গী হয়েছে । অথবা নীল আকাশে সাদা মেঘ নিরাসক্ত করেছে কবি মনকে। বর্ষায় যে বাউল মন একতারা বাজিয়ে আমের বনে জামের ক্ষেতে ঘুরে বেরিয়েছে, শরতে সেই মন সাধনায় সিদ্ধ। তাই কি এত নিরাসক্ত, উদাসীন?
‘আজ বিনা কাজে বাজিয়ে বাঁশি কাটবে সকল বেলা।।’
অথবা
‘কোন সাগরের পার হতে আনে কোন সুদূরের ধন–
ভেসে যেতে চায় মন,
ফেলে যেতে চায় এই কিনারায় সব চাওয়া পাওয়া’
বর্ষায় গ্রামীণ জীবনে থাকে ব্যস্ততা। কৃষিভিত্তিক সমাজ তথা জীবনশৈলী গ্রামের মানুষকে করে মাঠমুখী। মাঠেমাঠে চলে ধানচারা রোপণের কাজ। শরতের সোনালী রোদ মেখে ধানের চারা লকলকিয়ে উঠতেই মাঠের কাজ প্রায় শেষ। টলমল পায়ে হাঁটতে শেখা ধানের ক্ষেতকে আগলে রাখা ছাড়া কোনও কাজ নেই কৃষকের। গ্রামীন জীবনে তখন অখন্ড অবসর আর সোনালী ধানের অপেক্ষা। এই অবসর উদাসীন করে তোলে মনকে। এই উদাসীনতাই কবিকে গানের মধ্যে দিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে বেঁধে ফেলে।
‘কী করি আজ ভেবে না পাই, পথ হারিয়ে কোন্ বনে যাই
কোন মাঠে যে ছুটে বেড়াই সকল ছেলে জুটি। আহা, হাহা, হা।।’
সাদা কাশফুল , ফোঁটা শিউলির নিঃশব্দে ঝরে যাওয়া সব কিছুর মধ্যেই শরতের প্রকৃতি আর কবি, দুজনেই যেন অনাসক্ত, দুজনের মধ্যেই বর্ষা শেষের আলস্য। তাই তো কবি বলেন, শরৎ হ’ল ‘ছুটির ঋতু’।

‘সমস্ত সবুজ মাঠে,সমস্ত শিশিরভেজা বাতাসে উৎসবের আনন্দহিল্লোল বয়ে যাচ্ছে। অন্তরে বাইরে ছুটি ছুটি রব উঠেছে।’ এই ছুটিতে অবশ্য উৎসবের আমেজ। ‘শারদোৎসব’ নাটকে তা ধরা পড়েছে। শরতের উৎসবের সুরও বেজে উঠেছে কবির গানে।
‘আশ্বিনে নব আনন্দ,উৎসব নব।
অতি নির্মল,অতি নির্মল,অতি নির্মল উজ্জ্বল সাজে
ভুবনে নব শারদলক্ষী বিরাজে।’
অথবা
‘জানি গো আজ হাহারবে তোমার পূজা সারা হবে
নিখিল অশ্রু–সাগর–কূলে।।’
কিন্তু এ কার পূজা? জগৎসংসার যখন দূর্গাদেবীর আরাধনায় মগ্ন,কবিও মগ্ন। জগৎসংসার যখন দূর্গাবন্দনার মন্ত্র নিয়ে ধ্যান করছে, কবি তখন রয়েছেন গানের সুরে,কথার আড়ালে শরৎবন্দনায়। এও তো পুজোই, আরও ব্যাপক, আরও উদার। সীমার মাঝে বসে এক অসীমের পুজো। কবির ভাষায় ‘শারদেৎসবের মূল অর্থটি ঋণশোধের সৌন্দর্য্য।’ ভরা নদী,ক্ষেত ভরা শস্য নিয়ে প্রকৃতি শরতে যে ‘অমৃতশক্তি’ লাভ করে কবি সেই প্রকৃতিরই পুজো করেছেন এই গানগুলো দিয়ে।
ADVERTISEMENT