Paramita Gharai
January 03, 2017: Click here for Part I : উত্তরপূর্ব ভারতের বিস্ময়কর এক শিল্পভূমি – পর্ব ১
গাণিতিক সংখ্যা আর কল্পকাহিনীর হাত ধরেই হাতড়াতে হয় ইতিহাসের গর্ভে তলিয়ে যাওয়া ”ঊনকোটি”কে। ঊনকোটির ভাস্কর্য দ্রাবিড় ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জাভা-মায়ান্মার-কম্বডিয়ার নির্মাণ শৈলীর সাথে উপজাতি শৈলীর মিশ্রিত প্রতিফলন। ঊনকোটির ভাস্কর্যে দেবাদিদেব মহাদেবেরই আধিপত্য। অনার্য দেবতা শিব যেমন মিশে গেছেন আর্য দেবতাদের পুরাণে, তেমনি ত্রিপুরার উপজাতিদের ধর্মকাহিনীতে দেবাদিদেব স্বমহিমায় নিজের জায়গা করে নিয়েছেন। কুকী রমণীর প্রণয়াসক্ত হয়ে শিবের অধিষ্ঠান ঊনকোটিতে , আবার দিপারী মে’চিক নামে এক গারো মহিলাকে বিয়ে করেই শিবের অবস্থান এখানে। উপজাতীয় রীতি মেনেই দেবাদিদেব মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় পত্নীগৃহে বাস করেন। তাই কি তিনি’ঊনকোটিশ্বর”?
তিরিশ ফুট উচ্চতার ”ঊনকোটিশ্বর” নামধারী শিবের মুখমন্ডলের অবয়ব পূর্বভারতের মাটিতে দাবী রাখে এক ব্যতিক্রমী ভাস্কর্যরীতির। ঊনকোটিশ্বর কালভৈরবের পাকানো আকর্ণবিস্তৃত পুরুষ্ট গোঁফের নীচে সারিবদ্ধ দাঁতের অবস্থান কি জাভা দ্বীপের মুখোশাকৃতি শিল্পকর্মের সাক্ষী? কালভৈরবের মাথায় মোচাকৃতি মুকুটের কারুকাজে কেন উপজাতিদের নিত্যদিনের ব্যবহৃত বাঁশের ঝুড়ির নকশা? বৌদ্ধিক শৈলীতে নির্মিত কালভৈরবের দীর্ঘকান কেন অলঙ্কৃত উপজাতি নারীর কুন্ডলে ? রকমারি বৈচিত্র্য নিয়ে মহাদেবের নানা বিচিত্র অবয়বের অবস্থান পাহাড়ের গায়ে।
অন্যান্য ভাস্কর্যগুলোও অনন্যতার দাবী রাখে।উদ্যত চাবুক আর লাগাম হাতে রথ চালনারত খোদিত নারী মূর্তি উপজাতি সমাজের মাতৃতন্ত্রের কথাই বলে। ঊনকোটির ভাস্কর্যে পরপর তিনটি গণেশের মূর্তির অবস্থান সম্ভবতঃ বাংলাদেশের ”গাণপত্য মন্ডলী”র প্রভাব । একাধিক দাঁত আর কর্ণ আভরণ হিসেবে শঙ্খের ব্যবহার এই নির্মাণগুলোকেও ব্যতিক্রমী করেছে। অধ্যাপক কল্যানকুমার দাশগুপ্তের ভাষায়, “দ্বাদশ- ত্রয়োদশ শতকের এই ত্রিগণেশ মূলত আর্যেতর জনগোষ্ঠীর, হয়তো বা নিম্নবর্গীয়দের,গণেশ সম্পর্কীয় দেবকল্পনার প্রত্যক্ষ প্রকাশ, যে প্রকাশে স্থানীয়তা বা আঞ্চলিকতার ভূমিকা প্রধান।'”
কালাইগিরি,দেবস্থল, মূর্তিছড়া,দেবতাছড়া সহ ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ সংরক্ষিত পাহাড় সংলগ্ন গ্রামগুলোতে ইতিহাস,পুরাণ আর মিথ্ জড়াজড়ি করে অজানা ভারতীয় সভ্যতাকে নীরবে বয়ে চলেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী। ইতিহাস বলে , পাল রাজাদের আমলে সমগ্র পূর্বভারতের শিল্প-সংস্কৃতির এক লক্ষণীয় পরিবর্তন হয়। পাল রাজাবংশের অনেক রাণী ও বঁধূরা ছিলেন দক্ষিণভারতীয়। পালযুগের স্থাপত্যে ও ভাস্কর্যে মেলবন্ধন ঘটেছিল হিন্দু ও বৌদ্ধ শৈলীর। এর প্রভাব ”ঊনকোটি” অঞ্চল এড়িয়ে যাবে কি ভাবে? কারণ বঙ্গদেশ থেকে মায়ান্মার হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রবেশ পথেই ”ঊনকোটি”র অবস্থান।
তাহলে দেবাদিদেব কি কোটিদেবতাকে নিয়ে বারাণসী যাচ্ছিলেন এই পথ দিয়েই?