Paramita Gharai
January 22, 2018: Click here for earlier Parts -> পর্ব ১ , পর্ব ২ , পর্ব ৩ , পর্ব ৪
আরাধ্য দেবতার সাথে মৃত্যুর পরে বিলীন হয়ে যাওয়ার মতো মিশরীয় ধারনা গারো সমাজে প্রচলিত। গারোদের মতে ”বালফাক্রম’ হল শেষ আশ্রয় যেখানে মৃত ব্যক্তি পূর্বপুরুষের সাথে মিলিত হয়। গারো হিলসে পাওয়া অষ্টধাতুর শিব ও জলাশয়ের শিবমন্দিরই ঐতিহাসিকদের মতে ”বালফাক্রম” । অথচ অষ্টধাতুর শিবমূর্তি দ্রাবিড়ীয় চিন্তার ফসল। গারোদের মৃত্যুপরবর্তী বিশ্বাসের সাথে মিশে গেছে শিব কল্পনা ও দ্রাবিড়দের মন্দিরশৈলী। ঊনকোটিতেও প্রতিফলিত হয়েছে এই বিশ্বাস। নাকি ঊনকোটি প্রতিফলিত হয়েছে মনখেমর গোষ্ঠীভুক্ত খাসি জাতিদের স্মৃতিমন্দির হিসেবে। কম্বোডিয়া থেকে ভারতের উত্তরপূর্বে আসবার সময় তাদের যাত্রাপথে পাওয়া সমাধিক্ষেত্রের ওপর রাখা আছে প্রস্তরখন্ড। এই ধর্মীয় দর্শনই কি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন চন্দ্রবংশীয় রাজা ত্রিলোচন? চন্দ্রবংশের শেষ রাজা ত্রিলোচনের শাসনকালেই কি শেষ হয়েছিল ঊনকোটির শিল্পশৈলী?
অন্ধ্রপ্রদেশের তাম্র-পত্তনের রাজা মনো-ধিরা ছিলেন দেবাদিদেবের উপাসক। তাঁর কন্যা ধেন্দাকে বিয়ে করেন আরাকান রাজ আনন্দচন্দ্র। অষ্টম শতকে তৈরী ম্রোহঙ্ অঞ্চলের সিত্থাউঙ প্যাগোডার স্তম্ভে উৎকীর্ণ একটি লিখনে আরাকানের ৫৪৭ বছরের ইতিহাসে এই তথ্যই পাওয়া যায়। আনন্দচন্দ্র ছিলেন চন্দ্রবংশীয় যাঁরা খ্রীষ্টিয় পঞ্চম শতক থেকে একাদশ শতক পর্যন্ত আরাকানের অধিপতি ছিলেন। আনন্দচন্দ্রের সময় থেকেই আরাকান প্রদেশের প্রশাসনিক ও সামাজিক কাজে দক্ষিণ ভারতীয় প্রভাব বাড়তে থাকে। বৈবাহিকসূত্রে আরাকান রাজাদের ধর্মবিশ্বাসেও পড়ে শৈব দর্শনের প্রভাব। ঐতিহাসিকরা মনে করেন ,কুমিল্লাতে আবিষ্কৃত নর্তেশ্বর-নট্টেশ্বর মূর্তিগুলো বাংলাদেশে শিবের জনপ্রিয়তাই নির্দেশ করে যা দক্ষিণদেশ থেকেই বঙ্গদেশে এসেছিল।
চন্দ্ররাজাদের শাসনকালেই বাংলা ও আসাম রাজ্যের ওপর দিয়ে স্থলপথে শুরু হয় বানিজ্য। সেই পথেই আরাকানে হাজির হন বৌদ্ধ পরিব্রাজকেরা। ফলস্বরূপ অষ্ট্রিক-দ্রাবিড়-হিন্দু-বৌদ্ধ দর্শনের মিশ্র প্রভাবে এক নতুন সংস্কৃতি ও শিল্পভাবনার জন্ম হয় আরাকান রাজ্যে , চন্দ্র রাজাদের শাসনকালে।
পৃর্ববাংলার ইতিহাসের পাতায় নবম -দশম শতকে আর এক চন্দ্রবংশের খোঁজ পাওয়া যায়। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে এই দুই চন্দ্রবংশীয় অভিন্ন। চন্দ্রবংশীয় শাসকদের মুদ্রায় রয়েছে চন্দ্র ও ত্রিশূলের চিহ্ন প্রমাণ করে যে তাঁরা ছিলেন শিবের উপাসক। ত্রিপুরার বিভিন্ন অঞ্চল সহ কাছাড় ও তার আশপাশে পাওয়া মুদ্রাগুলোর সময়কাল খ্রীষ্টীয় নবম শতক।চন্দ্রবংশীয় শাসক শ্রীচন্দ্র অসম আর শ্রীহট্টে নিজের অধিকার অর্জন করেছিলেন। তাঁর শাসনকালেই জারি হয়েছিল পশ্চিমভাগ তাম্রপত্র। সেটা দশম শতাব্দী। এই তাম্রপত্রে হদিশ মেলে মনুনদীর তীরে ইন্দ্রেশ্বর নৌবন্দরের। প্রায় ২৬০০ একর জমিতে গড়ে ওঠা এই নৌবন্দরের অনতিদূরে কুলাউরা । আর কুলাউরার পাশেই ঊনকোটি। তাহলে কি দক্ষিণভারতীয় শিল্পকলা নৌপথেই এসেছিল পূর্বভারতের শ্রীহট্ট লাগোয়া জঙ্গলঘেরা পার্বত্যভূমিতে?
পশ্চিমভাগ তাম্রলিপিতে রাজা শ্রীচন্দ্রের ভূমিদান প্রসঙ্গ উল্লেখ আছে। তাঁর রাজ্যের চন্দ্রপুর বিষয়(জেলা) তিনি ব্রাহ্মণদের দান করেন। ঊনকোটির ভৌগলিক অবস্থান চন্দ্রপুরের কাছেই। চন্দ্রপুরের সীমা নির্দেশ করতে গিয়ে তাম্রলিপিতে লেখা হয়েছে যে চন্দ্রপুরের পূর্বসীমান্তে আছে ”বৃহৎ কোটালী”। গবেষকদের মতে, দ্রাবিড় শব্দ ”কট্ট” বা ”কটা” ,যার অর্থ সুরক্ষিত অঞ্চল , তার থেকেই ”কোটালী” শব্দের আগমন। শ্রীহট্টের অন্তর্গত ঊনকোটির উল্লেখ আশ্চর্যজনক ভাবে তাম্রপত্রে অনুপস্থিত, চিহ্নিত কেবলমাত্র ”বৃহৎ কোটালী” বা সংরক্ষিত এলাকা বলে। গবেষকরা মনে করেন এই সময়েই চলছিল ঊনকোটির নির্মাণ কাজ। আর সেজন্যই সংরক্ষিত ঘোষনা করে স্থানটিকে সুরক্ষিত করেছিলেন চন্দ্রবংশীয় রাজা শ্রীচন্দ্র।
চন্দ্রবংশীয় রাজারা তাহলে কি নির্মাণ করছিলেন কোনো স্মৃতি মন্দির?
ঊনকোটি এক ভাস্কর্যের আকর। এক ব্যতিক্রমী শিল্পশৈলীর সাক্ষর। উত্তরপূর্ব ভারতের সভ্যতা ক্রম বিকাশের প্রকাশ ঊনকোটি। সুদীর্ঘ সময় ধরে বিভিন্ন ভাষা ও গোষ্ঠীভুক্ত মানুষের মিলিত প্রয়াস ঊনকোটি। হিন্দু-বৌদ্ধ-খেমর ও উপজাতীয় ধর্ম ও শিল্পের সম্মিলিত প্রতিফলন ঊনকোটি। কোন্ শিল্পীর ছেনী হাতুড়ির আঘাতে সেসময় এই জঙ্গলঘেরা পাহাড়ের স্তব্ধতা ভেঙেছিল জানা নেই। তবে ঊনকোটি পাহাড়ের পায়ের কাছে মুড়াইবাড়ির অধিবাসীদের কাছে ঊনকোটির পরিচিতি আজও ”বেলজেম-খুও” নামে। ”বেলজেম-খুও” কথাটির অর্থ শিল্পীর গ্রাম। সময়ের গন্ডি পার হয়ে মুড়াইবাড়ির অধিবাসীদের মুখে মুখে ঘোরে সেই গ্রামের শিল্পীদের গল্প, যাঁদের পুরোধা ছিলেন শ্রীকলা আর রাইকলা। ইতিহাস এঁদের সম্বন্ধে নীরব। তাতে কি এলো গেলো? দ্রাবিড় ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ অষ্ট্রিক জনগোষ্ঠীর প্রভাবে নির্মিত উত্তরপূর্ব ভারতের অনাবিষ্কৃত ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও জাজ্বল্যমান শৈবতীর্থ ঊনকোটি।