Paramita Gharai: Kolkata: Oct 05, 2016:
প্রথম পর্ব:
তখন জ্যৈষ্ঠ মাস।কলকাতাতে গরমে টেকা দায়। উত্তরমুখী ট্রেনগুলোতে জায়গা নেই। হঠাৎ সুযোগ এল বীরভূম যাবার। প্রস্তাবটা আমাদের এক সাহিত্যপ্রেমী বন্ধু পরিবারকে জানাতেই আঁতকে উঠলেন তাঁরা – ‘এই গরমে বীরভূম!’ দীর্ঘ আলাপচারিতার পর রওনা দিলাম মে মাসের শেষ সপ্তাহে। শিয়ালদা স্টেশন থেকে সকাল ৭.২৫ এর ট্রেন। ঘাম মুছতে মুছতে ট্রেনে উঠলাম। বেলা ১০.৪০-এ বোলপুর স্টেশনে যখন নামলাম তখন আগুন ঝরছে আকাশ থেকে। ভাবছি ‘না এলেই ভালো হতো’। যাই হোক, টোটো ভাড়া করে রওনা হলাম আমরা বাউটিজোলার দিকে।
বাউটিজোলা – পশ্চিমবঙ্গের এক আদিবাসী গ্রাম। মূলত সাঁওতালদের বাস। বোলপুর শহর পেরিয়ে বিশ্বভারতীকে বাঁদিকে রেখে আমাদের টোটো পৌঁছল শ্যামবাটীর মোড়ে। বাঁদিকে সোনাঝুরি আর ডানদিকে প্রান্তিক। আমরা চললাম সোজা। খাঁ খাঁ রোদ্দুর, জনহীন রাস্তাঘাট। লু-এর উত্তাপ মেখে শীর্ণকায়া কোপাই নদী পার হয়ে আমাদের টোটো এবার বাঁদিকের রাস্তা ধরল। লালমাটির রাস্তা বেয়ে, ছোট্টো নড়বড়ে সাঁকো পেরিয়ে আমরা বেলা ১২টা নাগাদ হাজির হলাম ‘আদিবাসী গ্রাম’ রেসর্টে।
রেসর্ট?! বলাটা ভুল হয়তো হল – ইট, পাথর দিয়ে তৈরি নয়, নকশা করা কোন রিসর্ট নয়। এক্কেবারে ভাবনার বাইরে গ্রামীণ স্টাইলের লাল টালি দেওয়া মাটির দোতলা আধুনিক রিসর্ট। টোটো সেই রিসর্টের সামনে দাঁড়াতেই দৌড়ে এল অরিন্দম – এই অদ্ভুত রিসর্টের সর্বেসর্বা। আপ্যায়ন করে নিয়ে এলো ‘রিসেপশন রুম’-এ। কাঠ বা লোহার গ্রিল নয়, সিমেন্টে মোড়া পথ নয় – বাঁশের দরজা ঠেলে বাগানের পথ পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম মাটি দিয়ে নিকেনো বিশাল গোল চাতালে। ওপরে তালপাতায় ছাওয়া ছাদ। ছাদটাকে ধরে রেখেছে গোল চাতালের চারপাশে ঘিরে থাকা তালগাছের কান্ড। ক্লান্ত-শ্রান্ত দেহগুলি এলিয়ে দিলাম বাঁশের তৈরী চেয়ারে, সোফায়। পাতিলেবু, নুন, চিনি আর আদার রস দিয়ে বানানো সরবত এলো, খাওয়ামাত্র চনমনে হয়ে উঠলো দেহ-মন।
চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অজস্র সবুজ ছোটোবড় গাছপালা, পাখি আর রঙিন প্রজাপতির মেলা। এরই মাঝে দোতলা মাটির বাড়ি। একতলা আমাদের থাকার জন্য বরাদ্দ হল। বারান্দা থেকে তিনটে সিঁড়ি উঠে গেছে একতলার ঘরে যাবার জন্য, ডানদিকের মাটির সিঁড়ি দোতলামুখী। একতলায় ঢুকেই বৈঠকখানা। কি নেই সেখানে? ছোট চৌকি, বসবার সোফা আর মাটির ‘তাকে’ সাজানো থরেথরে রবীন্দ্র–নজরুল–মানিক বন্দোপাধ্যায়–বিভূতিভূষণের বই-এর সম্ভার, আছে সেলিম আলি, গোপাল ভট্টাচার্যের লেখা বই, আর আছেন সুনীল – জয়। ঘরের এককোনে আর একটা ‘তাকে’ রাখা সিডি প্লেয়ারটা। গান চালিয়ে দিয়েছে আমাদের দুই ছেলে, বুবু আর সাগ্নিক – ‘বাজিল কাহার বীণা মধুর স্বরে’।
বৈঠকখানা ঘরের দুপাশে দুটো শোওয়ার ঘর, আধুনিক স্নানঘর; সঙ্গে মানানসই আসবাব। সবকটা ঘরেই ইতিউতি ছড়িয়ে আছে পশ্চিমবাংলায় তৈরী বিভিন্ন কারুশিল্পের নিদর্শন। আমরা এসি চালিয়ে দিলাম ঠান্ডা হবার জন্য। মাটির বাড়ির মোড়কে হাজির আধুনিক জীবনের সব বিলাসিতা, নাকি প্রয়োজন!
স্নান সেরে বাইরে এলাম। বারান্দা পেরিয়ে ঘাসের লন। একদিকের সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো বসবার
জায়গা। তার সামনেই রয়েছে ক্যাম্প ফায়ারের ব্যবস্থা। লনের ঠিক বিপরীত কোনায় আছে মঞ্চ। বারান্দার গা ঘেষে আরেক কোনায় তুলসীমঞ্চ। এই দুই-এর মাঝে অগভীর চৌবাচ্চায় নাম না জানা রঙিন ফুল ফুটে আছে। ডাক পড়ল দুপুরের খাবার খাওয়ার। গোল চাতালেই আয়োজন হয়েছে। মেনুতে ছিল উচ্ছেভাজা, মুগডাল, আলুভাজা, শুক্তো, নিরামিষ তরকারি, আমের চাটনি, পাঁপড়, মিষ্টি। বাইরে ‘প্রখর তপনতাপে’ হাওয়া তপ্ত।
চোখ পড়ল মাটির বাড়ির পেছনদিকে। কিছুটা জায়গা ছেড়ে বাগান। সেখানে কত রকমের জবার সমারোহ, রঙের কী বাহার। আছে টগর, নয়নতারা – ডালপালা ছড়ানো ডালিম আর বাতাবিলেবু গাছের ছায়ার নীচে আলতো হাওয়ায় দুপুরে ঝিমিয়ে নিচ্ছে তারা। রয়েছে শাল, সেগুন, জারুল গাছ। নীচে খাটিয়া পাতা, পাশে খেজুরপাতায় বোনা চাটাই বিছানো। দুটো শালগাছের কান্ডের সাথে বাঁধা দড়ির দোলনা। শালগাছের গা ঘেষেই ক’টা নারকেল, তাল, খেজুর গাছ দাঁড়িয়ে আছে। গাছ বেয়ে লাল– কালো, ছোটো–বড় পিঁপড়েদের অবিরাম অবিশ্রান্ত চলাফেরা। তালগাছের ওপর বিশাল বড় মৌচাকে মৌমাছিদের ভিড়, গুঞ্জন। খাওয়া শেষ হতে তিনটে বেজে গেল। বসলাম খাটিয়ায়। দোলনার দখল হয়ে গেছে আগেই। বিকেল নেমে আসে ধীরে ধীরে। পাখির দল কিচিরমিচির করে ভিড় জমাচ্ছে বড় বড় গাছগুলোর মাথায়, যেন সন্ধ্যার আবাহনী শুরু হয়েছে।
চা বানানোর ব্যবস্থা ঘরেই আছে – ইলেকট্রিক কেটলি, চা, চিনি, দুধ। নিজেরাই বানিয়ে নিয়ে সিমেন্ট বাঁধানো চেয়ারে বসি। সামনে ঘাসের লন বেয়ে এগিয়ে আসছে ১৫-১৬ জন সাঁওতাল কিশোরকিশোরী। মাটির বারান্দায় চাটাই বিছিয়ে চলে তাদের পড়াশোনা। অরিন্দম তদারকি করে তাদের। ততক্ষণে আমাদের রাতের খাবারের আয়োজন শুরু করেছে কালোমনি। বাগান আর তালপাতা ছাওয়া গোল ‘রিসেপশন কাম ডাইনিং’ এর জায়গা পার করে রান্না ঘর। দুপুরে ক্লান্ত থাকায় কালোমনিকে অতটা খেয়াল করিনি। এখন দূর থেকে দেখলাম। বছর তিরিশের সাঁওতাল রমণী, গায়ের রঙ কালো–একটা হলদে সুতির ছাপা শাড়ি পরা। মাথায় ঘোমটা। কাঠের জ্বালে রান্না করছে সে। রাত ৮টা বাজলে পড়ুয়ার দল চলে গেল। বাগানে লনে তখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিভিন্ন কোনায় থোকায় থোকায় জোনাকি জ্বলছে। হাওয়ায় ঠান্ডা আমেজ। রান্নাঘরের মাথার ওপরে উঁকি মারছে চাঁদ। দূর থেকে ভেসে আসছে মাদলের দ্রিম্ দ্রিম্ বোল। জোৎস্না বিছানো রাতের আকাশের একফালি যেন নেমে এসে মোহময়ী করা তুলেছে পুরো জায়গাটাকে। প্রকৃতির এই অপরূপ মদিরা কতক্ষণ আমাদের আচ্ছন্ন করে রেখেছিল তা জানিনা, তবে আমরা কেউ কারুর সাথে অনেকক্ষণ কথা বলতে পারিনি। মাদলের আওয়াজ অনেকক্ষণ আগে থেমে গিয়েছিল। আমরাও চুপ করে বসেছিলাম। সম্বিত ফিরল অরিন্দমের ডাকে। রাতের খাবার খেয়ে শুতে গেলাম । (চলবে …….)