|| Paramita Gharai ||
সবুজ জঙ্গলে ঢাকা লালমাটির পাহাড়। মাঝেমাঝেই মুলি বাঁশের ঝাড়। ফাঁকে ফাঁকে রিয়াং, জামাতিয়া, ত্রিপুরীদের গ্রাম। গ্রাম মানে দশ–বারোটা ঘর। গাছ–বাঁশ দিয়ে তৈরী আয়তাকার ঘরগুলো মাটি থেকে বেশ উঁচুতে। ঘরের তলায় মোরগ মুরগী ছানাপোনাশুদ্ধ কোঁকর–কোঁক করছে, কোথাও মা–শুকর কাচ্চা–বাচ্চাসহ বহাল তবিয়তে সংসার পেতেছে। সামনেই গোমতীর শান্ত সবুজ জলে গা ভিজিয়ে এক রিয়াং পুরুষ মেখে নিচ্ছে শীতল মদিরতা। পাহাড়ের পেছন থেকে ঝকঝকে সূর্যের আলো তার নির্মেদ শরীরের পেশী চুঁয়ে চলকে পড়ছে গোমতীর জলে । জুমের ফসল পাহারা দিয়ে সদ্য ফিরেছে সে। এখনো জুম পাহারার সুর তার গলায়। সেই সুর প্রতিটি পাহাড়ের আনাচে কানাচে ঘুরে ঘুরে জানিয়ে দিচ্ছে সুখের কথা–
আদুঅই মোকন্দা তুই ইয়ং য়্যাফা তুইমা
কাছলাই নুং বাইমা হিম খ্লাই,
থুইঅই খাছকু থাংখামুন।
( মগদামের পাতা ছাড়ালে যেমন সুন্দর দেখা যায়, তুমিও সেরকম সুন্দর। তোমার সঙ্গে পথ হাঁটলে আমি মরলেও শান্তি পাব।)
গোমতীর নিস্তরঙ্গ জলে ভিজে বহু শতক পার করে আজও সেই সুর আছড়ে পড়ে ভুবনেশ্বরী মন্দিরের দুয়ারে। রবি ঠাকুরের ‘রাজর্ষি’ খ্যাত মন্দিরটি আসলে রাজ পরিবারের বিষ্ণুমন্দির। ত্রিপুরার রাজ পরিবার, রাজা, রাজবাড়ি জড়িয়ে আছে ‘রাজর্ষি’ উপন্যাসে। রবি ঠাকুরের লেখনীর আঁচড়ে বাঙালী পা ফেলেছিল ত্রিপুরার রাজধানী উদয়পুরে। মানিক্য রাজবংশের রাজধানী উদয়পুর ছিল লিকা রাজাদের রাঙামাটি। লিকা রাজাকে হারিয়ে জুঝার ফা দখল করেন রাঙামাটি। রাজধানী কৈলাশহর থেকে চলে এল রাঙামাটিতে। মগরাজাকে হঠিয়ে শুরু হল ত্রিপুরী উপজাতির শাসন। ৫৯০ সালের এই ঘটনার একমাত্র তথ্যসূত্র ‘রাজমালা’। পাহাড়–বনানী–নদী ঘেরা রাঙামাটিতে যেমন আলো–আঁধারি, তেমনি রাঙামাটি বা উদয়পুরের ইতিহাস কখনো আলোকিত, কখনো অজানার গহন অন্ধকারে। রাজমালায় পাওয়া যায় মানিক্য রাজাদের কাহিনী। আর রাঙামাটি থেকে উদয়পুর হয়ে ওঠার ইতিহাস তৈরী হয়েছে এই মানিক্যরাজাদের ঘিরেই।
প্রায় ছ’শ বছরের ইতিহাসের সরণী বেয়ে গোমতী আজও কলকল শব্দ উদয়পুরের আকাশে পথেঘাটে প্রতিধ্বনি করে উপজাতি রাজার অহমিকা। ভুবনেশ্বরী মন্দিরের পাশে রাজবাড়ি সেই অহমিকায় আতিশয্য আনে। নক্ষত্র রায়–গোবিন্দমানিক্যের রাজবাড়ির আঙিনা ছেড়ে গোমতী পার হয়ে গোবিন্দমানিক্য সরণী ডানদিকে ঘুরেছে। সামনেই গুনবতী গুচ্ছ মন্দির। বৌদ্ধ গঠনশৈলীর এই তিনটে মন্দির তৈরী হয় রাজা গোবিন্দমানিক্যের রাণী গুণবতীর ইচ্ছানুসারে।
আর একটু পথ হাঁটলেই মহাদেব দিঘি। সেখানেই উদয়পুরের শৈবতীর্থ মহাদেব বাড়ি। রাজা ধন্যমানিক্য প্রতিষ্ঠিত ত্রিপুরেশ্বর ভৈরব আজও এখানে আরাধ্য। বৌদ্ধ আঙ্গিকে তৈরী আরো দুটো মন্দির এখানে দাঁড়িয়ে রাজ পরিবারের চোদ্দজন কুলদেবতাদের স্মৃতি বহন করে। তবে এই দেবতারা রাজা কৃষ্ণমানিক্যের সময় থেকেই পুরাতন আগরতলার বাসিন্দা। মন্দির–শহর উদয়পুরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে রাজন্য আমলে তৈরী অনেক মন্দির। মহারাজা কল্যানমানিক্য প্রতিষ্ঠিত চন্দ্রগোপীনাথের মন্দির, ভগ্নপ্রায় দ্যুতিয়াবাড়ি মন্দির, মহারাজা ধনমানিক্য প্রতিষ্ঠিত শ্রীহরি মন্দির রাজপরিবারের ধর্মবিশ্বাস আর গঠনশৈলীর বিভিন্নতার সাক্ষী। ভগ্নপ্রায় জগন্নাথ মন্দির সম্পূর্ণ আলাদা স্থাপত্যরীতিতে তৈরী। ত্রিপুরার একমাত্র শ্লেট পাথরের মন্দির এই জগন্নাথ বাড়ির চূড়া মোগল গঠনরীতির আদলে গম্বুজাকৃতি। মহারাজা গোবিন্দমানিক্যের অর্থে তাঁর ভাই জগন্নাথ দেব নির্মিত এই মন্দিরের আরাধ্য দেবতা ছিলেন ভগবান বিষ্ণু।

উদয়পুরের বিখ্যাত ত্রিপুরেশ্বরী মন্দির ‘মাতাবাড়ি’ নামেই বেশী পরিচিত। সতীপীঠের অন্যতম এই মন্দির ঘিরে আছে নানা কাহিনী। উদয়পুর যখন ছিল রাঙামাটি তখন শাসন করতেন লিকা রাজারা। সেসময়ের মগরাজাদের যে মন্দিরের কথা পাওয়া যায় সেটাই সম্ভবতঃ মানিক্যরাজাদের আমল থেকে ত্রিপুরেশ্বরী মন্দির। গ্রামবাংলার কুঁড়েঘরের আদলে নির্মিত মন্দিরটিতে হিন্দু স্থাপত্য রীতির ছাপ স্পষ্ট। রাজমালাতে আছে মহারাজা ধন্যমানিক্য চট্টলাচল থেকে মূর্তি এনে মাতাবাড়িতে প্রতিষ্ঠা করেন দেবী ত্রিপুরাসুন্দরীকে। প্রায় ৬ ফুট লম্বা কষ্টিপাথরের বিগ্রহের সঙ্গে পূজিত হন ছোটোমা। দু’ফুট উচ্চতার এই মূর্তিটি খুবই পুরোনো । মন্দির সংলগ্ন দিঘি কল্যানসাগরে কচ্ছপ আর মাছেদের অবাধ বিচরণ ।
কেবলমাত্র কল্যানসাগর নয়, সরোবর–শহর উদয়পুরে ছড়ানো ছেটানো মানিক্যরাজাদের শাসনকালে খনন করা অনেক দিঘি। জগন্নাথ দিঘি, মহাদেব দিঘি, রাজবাড়ি দিঘি, চন্ডাই দিঘি, অমরসাগর, ধন্যসাগর, বিজয়সাগর – এদের মধ্যে কয়েকটি।
দিঘি আর মন্দিরের মাঝেই উদয়পুর মসজিদের ধ্বংস স্তূপ ত্রিপুরার মাত্র আড়াই বছরের মুঘল জমানার সাক্ষ্য বহন করে। গুণবতী গুচ্ছমন্দিরের কাছেই ইটের দোচালা ঘরের বদর মোকাম হিন্দুমুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের কাছেই পবিত্র দরগা।
অতীত আর বর্তমানের পাশাপাশি সহাবস্থান এই শহরে। স্কুল, কলেজ, নিকটবর্তী পালটানা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, মহারানী সেচ প্রকল্পের সাথে তেপানিয়া ইকো পার্ক পর্যটকের আকর্ষণ কেন্দ্র।নতুন রেলপথে ট্রেনযাত্রার শুভারম্ভ উদয়পুরকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠার সম্ভাবনাকে উসকে দেয়। ছবিমুড়া, তৃষ্ণা অভয়ারণ্য, পিলাক, নীরমহল ঘুরে আসা যায় উদয়পুরকে কেন্দ্র করে।
সুদূর অতীত থেকেই হিন্দু–মুসলমান–বৌদ্ধ–উপজাতীয় সংস্কৃতির মিলেমিশে পথচলার নাম উদয়পুর। এই মিশ্র সংস্কৃতির স্পর্শে আধুনিক দুনিয়ার প্রশ্রয়ে এগিয়ে চলেছে গোমতী জেলার প্রশাসনিক সদর উদয়পুর।