ProMASS Feature Services: Aug 17, 2016: “আমি সগর্বে ঘোষণা করছি যে, আমি সেনেট হাউসে শেষ সমাবর্তনের দিন গভর্নরকে লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছিলাম। এ ঘটনার সম্পূর্ণ দায় আমি স্বীকার করছি। আমার উদ্দেশ্য ছিল মৃত্যুবরণ করা এবং আমাকে যদি মৃত্যুবরণ করতেই হয়, তা হলে তা যেন হয় মহান। স্বেচ্ছাচারী সরকারি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আমার এই সংগ্রাম, যা আমার দেশকে ‘অশেষ লজ্জা ও অবিরাম দুঃখ-যন্ত্রণা’র এক স্থায়ী দমন যন্ত্র করে রেখেছে, তা থেকে উদ্ধার করা এবং এমনভাবে লড়াই চালিয়ে যাওয়া যার বর্ণনা যথেষ্ট নয়”। ১৯৩২-এর ৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তনের দিন সেনেট হাউসে তৎকালীন বাংলার গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসন’কে লক্ষ্য করে পাঁচবার গুলি ছোঁড়ার দায়ে ধরা পড়ে যাওয়ার কয়েকদিন পর কলকাতা হাইকোর্টের বিশেষ বিচারসভায় সগর্বে একথা জানিয়েছিলেন বিদগ্ধ বাঙালি পণ্ডিত ও চিরস্মরণীয় শিক্ষক বেণীমাধব দাস-র ছোট কন্যা বীনা দাস। যদিও সেদিন পাঁচবার গুলি ছোঁড়ার পরও গভর্নর জ্যাকসন কোনওক্রমে প্রাণে বেঁচে যান। বীনা দাসের বিচার প্রক্রিয়ার পরের ধাপে এই দুঃসাহসী মহিলা যাকে ‘অগ্নিকন্যা’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল, বলেছিলেন, “আমি একথা স্বীকার করছি যে, কোনও ব্যক্তি বা এই জগতের কোনও বস্তুর প্রতি আমার শত্রুতা বা ঈর্ষা নেই। এমনকি, গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসন ও তাঁর স্ত্রী-এর প্রতিও আমার ব্যক্তিগত কোনও শত্রুতা নেই। কিন্তু, ব্রিটিশ সরকারের যে দমন-পীড়ণমূলক ব্যবস্থার প্রতিনিধি এই গভর্নর জ্যাকসন, তাঁদের কঠোর নীতি আমার ৩০ কোটি দেশবাসীকে বন্দী করে রেখেছে”।

ক্রিকেটের সোনালী অতীত যুগের অন্যতম সেরা ‘অল-রাউন্ডার’ স্ট্যানলি জ্যাকসন, যিনি ফ্রাঙ্ক স্ট্যানলি জ্যাকসন নামেও সুপরিচিত ছিলেন এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধবরা যাকে ‘জ্যাকার’ নামে ডাকতেন, সেই অতীতের দিনগুলিতে তিনি কেবল একজন সেরা ক্রিকেটার ছিলেন না, একজন ডাকসাইটে রাজনীতিক হিসাবেও ব্রিটিশ রাজনৈতিক মহলে পরিচিত ছিলেন। পরে, তিনি ব্রিটিশ সরকারের একজন বিচক্ষণ ও দায়িত্ববান কূটনীতিক হিসেব তৎকালীন বাংলার গভর্নর পদে আসীন হয়েছিলেন। মহাত্মা গান্ধীর ভাবধারা ও মতাদর্শে অনুপ্রাণীত হয়ে কলকাতায় মহিলাদের অন্যতম এক বিপ্লবী সংগঠন ‘ছাত্রী সংঘ’-এর সদস্য বীনা দাস ব্রিটিশ শাসনের ওপর জোরদার আঘাত আনতে স্ট্যানলি জ্যাকসন’কে লক্ষ্য করে পাঁচবার গুলি ছুঁড়েছিলেন। গুলি ছোঁড়ার দায়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হলেও, কয়েক বছর পর ১৯৩৯-এ ছেড়ে দেওয়া হয়।
সাইমন কমিশনের প্রতিনিধিরা ১৯২৮-এর ফেব্রুয়ারী মাসে ভারতে এসে পৌঁছনোর পর দেশ জুড়ে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রবল বিক্ষোভের মুখে পড়েছিলেন। এমনকি, বিক্ষোভ এতটাই উত্তাল আকার ধারণ করেছিল যে, পুলিশও পিছু হটেছিল। কিন্তু, দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটল ৩০ অক্টোবরের লাহোরে। সেদিন বিক্ষোভ প্রদর্শনের সময় পুলিশের রোষের মুখে পড়ে লালা লাজপত রাই গুরুতর আহত হলেন এবং তিন সপ্তাহ পর আঘাত সহ্য করতে না পেরে মৃত্যুবরণ করলেন। বীনা দাসও ব্রিটিশ বিরোধী বিক্ষোভে সক্রিয়ভাবে সামিল হয়েছিলেন। যদিও পরবর্তীকালে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর সঙ্গে সাক্ষাতের পর তাঁর মতাদর্শে আমূল পরিবর্তন ঘটেছিল। এদিকে ১৯২৭-এ বাংলার গভর্নর হিসেবে জ্যাকসন দায়িত্বগ্রহণ করলে, তাঁকে ‘নাইট গ্র্যান্ড কমান্ডার’-এর সম্মান দেওয়া হয়’।

১৯৩০-এ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন এক ব্যাপক আকার ধারণ করে। জাতির জনক গান্ধীজী ১৯৩০-এর ১২ মার্চ ‘লবণ সত্যাগ্রহ’ বা ডান্ডি অভিযানের সূচনা করলে দেশ জুড়ে শুরু হল ব্যাপক আইন অমান্য আন্দোলন। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে ‘পূর্ণ স্বরাজ’ কর্মসূচির কথা ঘোষণা করা হল ১৯৩০-এর ২৬ জানুয়ারি। উচ্চপদস্থ ব্রিটিশ পুলিশ আধিকারিক জন সানডার্স’কে হত্যার অভিযোগে ভগৎ সিং’কে কারাবন্দী করা হল। কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের ভেতরে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক শব্দ ব্যবহার ও বোমা ফেলার অভিযোগও তাঁর বিরুদ্ধে আনা হল। ভারতীয় ও ইউরোপীয় কারাবন্দীদের সমানাধিকারের জোরালো দাবি তুলে ভগৎ সিং সে সময়কার ভারতীয় যুবসম্প্রদায়ের কাছে ‘রোল মডেল’ হয়ে উঠেছিলেন।
এদিকে, কলকাতাতেও বীনা দাস এক মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ কাজের দায়িত্ব নিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনের দিন চরম অত্যাচারী ব্রিটিশ গভর্নর জ্যাকসন’কে নিধনের পরিকল্পনা করলেন। কিন্তু, সমাবর্তন অনুষ্ঠানে জ্যাকসন’কে লক্ষ্য করে পর পর পাঁচবার গুলি ছুঁড়লেও, একটিও তাকে স্পর্শ করেনি। দুর্ভাগ্যবশত বীনা দাসের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয় এবং বরাত জোরে গভর্নর জ্যাকসন প্রাণে বেঁচে যান। বীনা দাস যে বন্দুক থেকে গভর্নরকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়েছিলেন, সেটি আর এক মহান বিপ্লবী সুধীর ঘোষ-এর মাধ্যমে ২৮০ টাকায় নেওয়া। ‘অগ্নিকন্যা’ হিসেবে পরিচিত বীনা দাস’কে গুলি ছোঁড়া ও হত্যার পরিকল্পনার দায়ে গ্রেপ্তার করার পর একটানা ৪৮ ঘন্টা ধরে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় এবং জানতে চাওয়া হয়, এই পরিকল্পনায় কে বা কারা যুক্ত। কিন্তু, দুঃসাহসী এই বঙ্গকন্যা কারও নাম মুখে আনেননি। তবে, এই ঘটনার দায়ে তাঁকে দোষী সাবস্ত করে নয় বছরের কারাদন্ড দেওয়া হয়। ১৯৩৯-এ কারাবাসের মেয়াদ শেষ হলে গরাদ থেকে বাইরে এসে পুনরায় তাঁর বিক্ষোভ জারি থাকে এবং ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন। পরবর্তীকালে বীনা দেবী বাংলার বিধান পরিষদের (১৯৪৬-৫১) সদস্য হন।

এক মহান ও দুঃসাহসী স্বাধীনতা সংগ্রামী হওয়ার পাশাপাশি, বীনা দেবী একজন বিশিষ্ট শিক্ষিকা হিসেবেও স্মরণীয় থাকবেন। তিনি তরুণ-তরুনীদের ইংরাজী ভাষার শিক্ষা দিতেন এবং শেখাতেন কিভাবে সঠিক ইংরাজি লেখা যায়। দক্ষিণ কলকাতায় যোধপুর পার্কে থাকাকালীন তিনি বেশ কিছুদিন নিজেকে শিক্ষামূলক কাজকর্মে যুক্ত করেছিলেন। এরপর, তিনি হঠাৎই একদিন কোনও এক অজানা কারণে তাঁর যোধপুর পার্কের বাড়ি ছেড়ে চলে যান। বাড়িতে আর তিনি ফেরেননি। ১৯৮৬-এর ২৬ ডিসেম্বর বীনা দেবীর প্রয়াণ ঘটে। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জন্য পেনশন প্রকল্পসহ সরকারের আরও যে সমস্ত আর্থিক সহায়তা কর্মসূচি রয়েছে, সেগুলির সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। এই সময় তিনি পৌরসভার একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন বলেও জানা যায়। বাংলায় তিনি দুটি আত্মজীবনী রচনা করেছিলেন। এর একটি ‘শৃঙ্খলের ঝঙ্কার’ ও অন্যটি ‘পিতৃধান’। শিক্ষকতার দিনগুলিতে যখন ছাত্রছাত্রীরা তাঁর অসীম বীরত্বের বিভিন্ন ঘটনার কথা শুনতে চাইত, তখন তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গভর্নর জ্যাকসনকে লক্ষ্য করে গুলি চালানোর গল্প শোনাতেন এবং দু’পক্ষের মধ্যে গোলাগুলির লড়াইয়ের সময় নিজের গলার কাছে গভীর ক্ষতস্থান তাদের দেখিয়ে দিতেন। তাঁর স্বামী ‘যুগান্তর’ গোষ্ঠীর অন্যতম এক স্বাধীনতা সংগ্রামী জ্যোতিষ ভৌমিক-এর প্রয়াণের পর বীনা দেবী অত্যন্ত সহজ-সরল-অনাড়ম্বরভাবে জীবনযাপন করতেন।
যোধপুর পার্কে যে আবাসনের ফ্ল্যাটে বীনা দেবী থাকতেন, সেই আবাসনের এক প্রতিবেশীর কাছ থেকে জানা যায় যে, ১৯৮৬ সালের ২৬ ডিসেম্বর মৃত্যুর কয়েকদিন আগে প্রাতঃভ্রমণের কথা বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আর ফেরেননি। তাঁর পার্থীব দেহ আংশিক পচন ধরা অবস্থায় ঋষিকেশের গঙ্গার পাড় থেকে উদ্ধার করা হয়। এইভাবে মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী বীনা দেবী নিঃশব্দে সমস্ত মোহত্যাগ করে নশ্বর দেহ ত্যাগ করেন।
১৯১১ সালের ২৪ আগস্টে জন্ম দুঃসাহসী এই স্বাধীনতা সংগ্রামীকে আমাদের সশ্রদ্ধ প্রণাম।
…………………………………………………………………………………. শ্রীমতী শ্রীজাতা সাহা সাহু
- লেখক : পি আই বি, কলকাতার আধিকারিক।